গৌরব গুপ্ত: ভারতের একমাত্র দ্বীপ রাজ্য আন্দামান ও নিকোবর। চারিদিকে সমুদ্রে ঘেরা মোট ৫৭২ টি দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই দ্বীপ রাজ্য। এরমধ্যে মাত্র ৩৮ টি দ্বীপে মানুষ বসবাস করে এবং ১২ টিতে চলে পর্যটন। এই আন্দামানের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার। এখান থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থান করছে একটি দ্বীপ যার নাম ‘নর্থ সেন্টিনেল’। এই উত্তর(নর্থ) সেন্টিনেল দ্বীপে এমন এক প্রজাতির মানুষ বসবাস করে যারা আজও সভ্য সমাজ থেকে বহু ক্রোশ পিছিয়ে।
এখানে বিশ্বের বিচ্ছিন্নতম প্যালিওলিথিক উপজাতিরা থাকেন। এদের সাধারত নর্থ সেন্টিনালিজ বলা হয়, আবার ক্যানিবাল বা নরখাদকও বলা হয়ে থাকে। সভ্য সমাজের মানুষ যতবারই এদের সংস্পর্শে আসার চেষ্টা করেছে ততবারই এরা শানিয়েছে আক্রমণ। আজ এই প্রতিবেদনেই উন্মচিত হবে সেন্টেনেল দ্বীপে বসবাসকারী এই উপজাতির রহস্য।
উত্তর এবং মধ্য আন্দামান, দক্ষিণ আন্দামান, আর নিকোবর এই তিনটি ভাগের সমন্বয়ে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ গঠিত। পোর্ট ব্লেয়ার হল এর রাজধানী যা দক্ষিণ আন্দামানে অবস্থিত। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে জঙ্গলে ঘেরা উত্তর সেন্টিনাল দ্বীপ। এই দ্বীপের পরিধি ৬০ বর্গ কিলোমিটার। এখানেই বিশ্বের একমাত্র যোগাযোগবিহীন প্রজাতির মানুষের বাস।
ইতিহাসবিদদের মতে আজ থেকে প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে কিছু পরিযায়ী মানুষ রওনা দেয় এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। একে আফ্রিকা থিওরি বলা হয়। এই তত্ত্ব অনুসারে আন্দামানে যে বিরল মানব প্রজাতি রয়েছে তা এদেরই বংশদ্ভুত। জানলে অবাক হতে হয় এই উপজাতির মানুষের ভাষা আজও আমাদের কাছে অজানা। আমরা এদের নর্থ সেন্টিনালিজ বা ক্যানিবাল যাই বলি না কেনো এরা নিজেরা নিজেদের কি নামে অভিহিত করে সেটা আমাদের কাছে আজও অজানা।
আজ থেকে প্রায় ১০ – ৩০ হাজার বছর আগে এরা এই দ্বীপে পা রাখে। তখন থেকেই এরা বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগহীনভাবে বাঁচতে থাকে গোপনে। এরা কৃষিকাজের ব্যবহার জানে না তাই এদের প্রস্তর যুগের মানুষ বললেও খুব একটা ভুল বলা যায় না। সাধারণত গাছের ফল, সামুদ্রিক মাছ, বা বন্য জন্তু শিকার করেই এরা খেয়ে থাকে।
আন্দামানে এই প্রজাতির মানুষের প্রথম হদিস পাওয়া যায় খিষ্ট্রিয় ২য় শতাব্দীতে রোমান গণিতবিদ ক্লোডিয়াস টলেমির লেখা থেকে। তিনি আন্দামানের দ্বীপে বসবাসকারীদের ক্যানিবেল বা নরখাদক বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তবে প্রধানত যদি উত্তর সেন্টিনেল আইল্যান্ডের কথাই বলা হয় তবে এর প্রথম রেকর্ড পাওয়া যায় ১৭৭১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি জাহাজ দ্বারা।
এর পরবর্তী ঘটনা ঘটে ১৮৬৭ সালে। ১০০ জন যাত্রীসহ একটি ভারতীয় জাহাজ দুর্ঘটনাগ্রস্থ হয় এই দ্বীপের কাছাকাছি। জাহাজের যাত্রীরা নিকটবর্তী এই দ্বীপে আশ্রয় নিতে গেলে তাদের উপর আক্রমণ চালায় সেন্টিনালিজ অধিবাসীরা। ভাগ্যক্রমে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান রয়েল নেভি দ্বারা তাদের উদ্ধার করা হয়। এটাই ছিল প্রথমবার যখন এই দ্বীপের অধিবাসীরা বাইরের মানুষ দেখে আক্রমণ চালায়। এরপর ১৮৮০ সাল। মরিস ভিদাল পোর্টম্যান নামের একজন ব্রিটিশ অফিসার উদ্যোগ নেন আন্দামানে বসবাসকারী মানুষদের সাথে সভ্য সমাজের মানুষের যোগাযোগ স্থাপন করার।
আন্দামানের অন্যান্য দ্বীপে তার প্রচেষ্টা সফল হলেও ব্যর্থ হতে হয়েছিল উত্তর সেন্টিনাল দ্বীপে। এই দ্বীপে বসবাসকারী মানুষদের ভাষা আন্দামানের অন্যান্য দ্বীপের মানুষদের থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা। এর ফলে তাদের সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। কিন্তু তিনি ঘটিয়েছিলেন এক অন্য কাণ্ড। দ্বীপের তীর থেকে তিনি অপহরণ করে নিয়েছিলেন চারজন সেন্টিনালিইজ দ্বীপ নিবাসীকে। যাদের মধ্যে ছিলো এক বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা আর দু জন বাচ্চা। এই দ্বীপের মানুষ দীর্ঘকাল বাকি বিশ্বের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই দুর্বল। এর ফলে বাইরের দুনিয়ায় পা রাখার কিছুদিনের মধ্যেই রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায় বয়স্করা এবং বাকি দুজনকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাদের নিজস্ব দ্বীপে।
স্বাধীনতার পরে ভারত সরকার উত্তর সেন্টিনাল দ্বীপে অনেকগুলি অভিযান চালায়। ১৯৬৭ সালে প্রথম সরকারি অনুমতিতে নৃতত্ত্ববিদ ত্রিলোকনাথ পন্ডিত ২০ সদস্যের দল নিয়ে উত্তর সেন্টিনাল দ্বীপে প্রবেশ করেন। প্রথমবারের অভিযানে তাকে শুধু সেন্টিনালিজদের পায়ের ছাপ দেখেই ফিরে আসতে হয়। এর পর তিনি আবার এই দ্বীপে পাড়ি দেন ১৯৭৪ সালে একটি সিনেমার দলের সাথে। তবে এবার তিনি সঙ্গে করে নিয়েএসেছিলেন এক অন্য অভিজ্ঞতা। দ্বীপের ওপর কিছু ফলমূল ও একটি জ্যান্ত শুয়োর উপহারস্বরূপ রেখে তারা দূরে ক্যামেরা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন এই উপজাতির মানুষদের প্রতিক্রিয়া দেখতে। সেন্টিনালিজরা শুয়োরটিকে দেখে তৎক্ষণাৎ আক্রমণ করে হত্যা করে এবং পুঁতে দেয় সমুদ্র তীরে বালির চরে। বলা বাহুল্য এটাই ছিল প্রথমবার যখন এই বিচ্ছিন্ন প্রজাতির মানুষদের ক্যামেরাবন্দী করা সম্ভব হয়েছিল।
এরপর ১৯৯১ সাল, ইতিহাসে প্রথমবার এই সেন্টিনালিজ মানুষদের সাথে সভ্য সমাজের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল এই সময়। ১৯৯১ এর জানুয়ারি মাসে ভারতীয় নৃতত্ববিদ মধুমালা চট্টোপাধ্যায় তার ছোট্ট দলের সাথে এই দ্বীপে অভিযান চালায়। এবার ঘটে এক আশ্চর্য ঘটনা। মধুমালাদেবী ওই দ্বীপে বসবাসকারী সেন্টিনালিজদের জন্য উপহারস্বরূপ নিয়ে গেছিলেন
নারকেল। এটাই ছিল প্রথমবার যখন এই কুখ্যাত দ্বীপ নিবাসীরা সভ্য সমাজের মানুষের থেকে উপহার গ্রহণ করেছিল। এরপর তারা আবারও অভিযান চালায়। অ্যাডাম গুডহার্টের লেখা থেকে জানা যায়, পরের যাত্রায় একজন সেন্টিনালিজ পুরুষ তীর ধনুক হাতে মধুমালা দেবীর দিকে নিশানা করলে একজন সেন্টিনালিজ নারী তা প্রতিহত করে। এবং এই প্রথম কোনো অভিযানকারী দল নিজের হাতে সেন্টিনালিজদের উপহারস্বরূপ নারকেল দিতে সমর্থ্য হয়। এই ঘটনার ঠিক একমাস পরে আবারো একটি অভিযান চালানো হয়। এবার মধুমালা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ত্রিলোকনাথ পন্ডিত। এটাই ছিল শেষবার। যখন এই দ্বীপ নিবাসী মানুষেরা সভ্য মানুষের থেকে কিছু উপহার গ্রহণ করেছিল।
১৯৯১ এর পর যতবারই অভিযান চালানো হয়েছে ততবারই সভ্য মানুষের প্রতি দ্বীপ নিবাসী সেন্টিনালিজরা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। এই সূত্রে ভারত সরকার উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপ থেকে ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা সাধারন মানুষের জন্য নিষিদ্ধ করেছে। তবে আজ থেকে ঠিক ৪ বছর আগে আবার একটি নরকীয় ঘটনার স্বীকার হতে হয়। ২০১৮ সালে জন এলেন চাও নামক একজন ২৬ বছর বয়সি আমেরিকান মিশনারী বেআইনিভাবে এই দ্বীপে প্রবেশ করে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। প্রথম দু এক বার প্রাণে রক্ষা পেলেও তার ধর্ম প্রচারের জেদ তাকে শেষ রক্ষা করতে পারেনি। আন্দামানের স্থানীয় জেলেরা দূর থেকে সেন্টিনালিজদের দ্বারা জন এর মৃতদেহ বালি চাপা দিতে লক্ষ্য করে।
এই ঘটনা থেকে এটুকু স্পষ্ট হয় যে উত্তর সেন্টিনালিজরা খিদে মেটাতে মাছ বা বন্য পশু শিকার করলেও তারা নরখাদক নয়। দ্বীপের অন্তরালে বসবাসকারী এই অতি পুরাতন মানব জাতিকে তাদের মত থাকতে দেওয়াই ভালো। এর থেকে আমাদের দূরে থাকাই উচিত, এতে শুধু আমদেরই নয় ওদেরও মঙ্গল।