বাংলায় প্রবাদ আছে ‘টাকার গাছ’। আদতে টাকার গাছ বলে কিছু নেই জেনেও আমরা প্রবাদ শুনিয়ে থাকি। ঝাকালেই টাকা পড়বে। আবার মনে পড়ে বিখ্যাত হিন্দি সিনেমা ‘ফির হেরা ফেরির’ সেই মজার দৃশ্য, যেখানে মাত্র ২৫ দিনেই টাকা ডবল অর্থাৎ দ্বিগুণ হওয়ার আশায় একটি চিটফান্ড কোম্পানিতে টাকা লাগিয়ে ডোবার কাহিনী। কিন্তু কয়েকবছরেই মধ্যেই সেই টাকার গাছের কল্পকাহিনী বা ২৫ দিনে পয়সা দ্বিগুণ হওয়ার ঘটনা সত্যি হয়েছে। হ্যাঁ, আমরা এখানে ‘বিটকয়েন’(bitcoin) বা অন্য ক্রিপ্টোকারেন্সির(cryptocurrency) কথাই বলছি।
সম্প্রতি যা রাতারাতি বহু মানুষকে বিলিনিয়র বা ভারতীয় কথায় শূন্য থেকে কোটিপতি বানিয়ে দিয়েছে। ২৫ দিন নয়। তারও কম সময়ে পয়সা প্রায় ডবলের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়েছে। বিশ্বের বিখ্যাত ইলেকট্রনিক গাড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থা ‘টেসলা’ কোম্পানির প্রধান ‘ইলোন মাস্ক’(Elun musk) ক্রিপ্টোকারেন্সি ‘বিটকয়েন’ ও ‘ডাচকয়েন’(Dogecoin) নিয়ে কয়েকটি টুইট করায় যার মূল্য আকাশ ছোঁয়া হয়েছে। ভারতীয় বিনিয়োগকারী কথা বাঙালিদের মধ্যেও ‘বিটকয়েন’ এ বিনিয়োগ করার আগ্রহ বাড়ছে। গত এক বছর আগে কোনও ব্যক্তি যদি ৩০ মে ২০২০ তে ৭ লক্ষ টাকা দিয়ে একটি ‘বিটকয়েন’ কিনেছিলেন ১৩ এপ্রিল ২০২১ এ তার দাম হয়ে ছিল প্রায় ৪৮ লক্ষ টাকা। যদিও বর্তমানে ৩১ মে সেই প্রতি ‘বিটকনেয়ের’ মূল্য প্রায় ২৬ লক্ষ টাকা হয়েছে কমে গিয়ে। প্রতিনিয়ত এর মূল্য ওঠানামা করছে। মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আপনার টাকা বহুগুন বেড়ে যেতে পারে।
কিন্তু কি আসলে এই ‘বিটকয়েন’ ? (What is Bitcoin)
বিটকয়েন হল বিশ্বের প্রথম ক্রিপ্টোকারেন্সি। এমন মুদ্রা যা কেবল ইন্টারনেট জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ইন্টারনেট সার্ভার ব্লকচেইন(Blockchain) পদ্ধতিকে ব্যবহার করে তৈরি। যেখানে একব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিকে টাকার মতোই এই ‘বিটকয়েন’ পাঠানো যায় নির্দিষ্ট আইডি ব্যবহার করে। সাধারণভাবে অনলাইনে টাকা লেনদেন করার জন্য ব্যাঙ্কের প্রয়োজন হয়। ব্যাঙ্ক মধ্যস্থতা করে। ব্যাঙ্কের বা সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ থাকে। এই ক্ষেত্রে মধ্যস্থতায় কেউই থাকেন না। একব্যক্তি থেকে অন্যব্যক্তি সরাসরি লেনদেন করতে পারেন। ব্যবহারকারীরা যা প্রকাশ্যে সব লেনদেন দেখতে পেলেও ব্যবহারকারীদের আসল পরিচয় গোপন থাকে। কে বিটকয়েন (টাকা বা মূল্য বুঝুন) কাকে দিয়েছে তা জানা সম্ভব নয়। সমস্তটাই হয় কোডিং এর মাধ্যমে। যাতে কোনও দেশ বা সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সম্পূর্ণ সিস্টেমই চলে সফটওয়ার নির্ভর ‘ব্লকচেইনে’। যা খুবই জটিল বিষয় মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। সম্পূর্ণভাবে বুঝতে গেলে অ্যাডভান্স কম্পিউটার সাইন্স টেকনোলজি জানা প্রয়োজন হয়। সমস্ত ‘বিটকয়েন’ লেনদেনের হিসাব রাখার জন্য পাবলিক খাতা ‘লেজার’(Ledger) মেনটেন করা হয়। কোনও নির্দিষ্ট ব্যাঙ্কে তা থাকে না। সম্পূর্ণ উন্মুক্তভাবে থাকে। যারা যেই কম্পিউটার সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত। তাঁরাই সম্পূর্ণ তথ্য দেখতে পান। তবে, নাম নয়। কোডে। যার হিসাব করার জন্য খুবই অত্যাধুনিক প্রসেসারের কম্পিউটার প্রয়োজন হয়। এই পদ্ধতি ‘মাইনিং’(bitcoin mining) নামে পরিচিত। যে কেউ এই কম্পিউটার সিস্টেম বসিয়ে নিজের বাড়িতে এই ‘মাইনিং’ করতে পারে।
কীভাবে কাজ করে ?
ধরুন, ভারতের কোনও ব্যক্তি আমেরিকার কোনও ব্যক্তিকে ওয়ালেট বা বিটকয়েন ডট অর্গের (www.bitcoin.org) মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছেন। সেই হিসাব কয়েক হাজার কম্পিউটারের মাধ্যমে করা হতে থাকে। ‘মাইনিং’ করে হিসাব সঠিক হওয়ার পরই বিটকয়েন পাঠানো সম্ভব হয়। ব্যাঙ্কিং সিস্টেম হ্যাক করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটলেও এই পদ্ধতিয়ে ‘ক্রিপ্টোলজি’ বা ‘ব্লকচেইন’ হ্যাক করা অসম্ভব। একটি কম্পিউটার এই দুর্নীতি করতে চাইলেও অন্য যুক্ত কম্পিউটার তা আটকে দেবে। এই ‘মাইনিং’ এর কাজ যারা করেন তাঁদের উপহার হিসাবে ‘ বিটকয়েন’ দেওয়া হয়।
বিশ্বের নানা স্থানে চালু থাকা কম্পিউটার সার্ভারে তার ডেটা থাকে। খুবই কম সময়ের মধ্যে টাকা লেনদেন করা যায় একদেশ থেকে অন্য দেশে। মাত্র ৪ সেকেন্ড থেকে ১০ মিনিট পর্যন্ত সময়ে এই কাজ হয়। যেখানে একটি ব্যাঙ্ক প্রায় একদিন বা তারও বেশি সময় নিয়ে নেয়। কিন্তু সব থেকে বড় বিষয় হল এই ‘বিটকয়েন’ আদতে কোনও কয়েন নয় যা আপনি হাতে ধরতে পারবেন। বা তা আপনার পকেটে রাখতে পারবেন । সোনা যেমন আপনি বাড়িতে রাখতে পারেন, হাতে ধরতে পারেন তেমন কিন্তু ধরতে পারবেন না। তবে, বর্তমানে বহু কোম্পানি লেনদেনের মাধ্যম হিসাবে এই ‘বিটকয়েন’ বা আরও বিকল্প ‘অলট-ক্রিপ্টোকারেন্সি’(alt cryptocurrency) গ্রহণ করছে। যাতে বিশ্বের বহু মানুষ এই ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করছেন।
প্রাচীনকালে যেমন আমাদের সমাজে লেনদেনের মাধ্যম সোনা ছিল। ধরুন আপনার কাছে ১০ কেজি চাল আছে। আপনার প্রতিবেশির কাছে ১০ কেজি ডাল আছে। দুইয়েরই বাজার মূল্য আলাদা। যখন টাকা টাকা বা মুদ্রার প্রচোলন হয়নি তখন লেনদেনের মাধ্যম হিসাবে সোনার ব্যবহার হত। কিন্তু ধীরে ধীরে সে সময়ের সমাজ পরিচালক, রাজারা সেই সোনার পরিবর্তে সোনার কয়েন চালু করেন। পরে সেই তা ধীরে ধীরে কাগজের নোটে আসে। কারণ খুচরো চাল কিনতে গেলে তো সব সময়ই সোনা দেওয়া সম্ভত হত না। সেই সরকারি বা রাজকোষে সেই সোনা জমা রেখে টাকার নোট প্রচলন করা হয়। পরে বর্তমানে সেই টাকাই প্রচলন রয়েছে। সেই সঙ্গে এসেছে ডিজিটাল পেমেন্ট। বা ডিজিটাল মুদ্রা। মোবাইল ওয়ালেট বা ক্রেডিট, ডেবিট কার্ডে আপনার টাকার অঙ্ক দেখায়। যা প্রয়োজনে আপনি ব্যাঙ্কে বা এটিএমে গিয়ে টাকা তুলতে পারেন। আবার ডিজিটাল পেমেন্ট করেতেও পারেন। তবে, প্রতিদেশের তো আলাদা ব্যাঙ্কিং ব্যাবস্থা। আলাদা আলাদা নামের ব্যাঙ্ক। আপনার উপার্যনের টাকা ব্যাঙ্কে রাখলেন। ব্যাঙ্ক যদি কখনও ডুবে যায় সেই সঙ্গে আপনার টাকাও প্রায় ডুবে যেতে পারে। বিশ্বে বহুবার এমন ঘটনা ঘটেছে। সরকারের কারণে সাধারণ মানুষের টাকা ডুবেছে। বা সিস্টেমের জন্য দেশ বা বিশ্ব মন্দার মুখোমুখি হয়েছে। ফলত এর বিকল্প ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন এই ক্রিপ্টোকারেন্সিই হল সেই বিকল্প অর্থনীতি। যেখানে আপনার টাকা আপনারই থাকবে। কোনও মধ্যবর্তী ব্যাঙ্ক বা সরকার থাকবে না। একেবারে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকেন্দ্রিকরণ। ২০০৯ সালের গোটা বিশ্বের কাছে এই প্রথম ক্রিপ্টোকারেন্সি ‘বিটকয়েন’ এর পরিচয় করান সাতোশি নাকামোটো নামে এক ব্যক্তি বা একাধিক ব্যক্তি। যা এক রহস্য । কারণ এই ব্যক্তি কোনও দিনই প্রকাশ্যে আসেননি। তারপর থেকে ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
বর্তমানে ভারত সহ নানা দেশের খুবই দ্রুততার সঙ্গে এই ‘বিটকয়েন’ বা অন্য ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলির প্রচার পেতে থাকে। ২০১৮ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া এই ধরণের এক্সচেঞ্জের উপর কার্যত নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পরে সুপ্রিমকোর্টের রায়ের ভিত্তিতে সেই ব্যান বা নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া হয়। এখন এদেশ থেকেই ব্যাঙ্কের টাকা দিয়ে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে এই ‘বিটকয়েন’ কেনা যায়। প্রায় শেয়ার বাজারের মতো যার মূল্য ওঠানামা করতে থাকে। বরং তার থেকেও দ্রুত হয়। আরও অনেক বেশি ঝুঁকি। যা রাতারাতি আপনার টাকা কয়েকগুন বাড়িয়ে দিতে পারে। আবার কমিয়েও দিতে পারে। তবে, এখনও অবধি একেবারে বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েনি এই পরিচিত ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলি।
অন্যদিকে সরকার ও বিশেষঞ্জরা মনে করেন, এর মাধ্যমে অনেক দুর্নীতি করা সহজ। অস্ত্র, মাদক কারবারে ও হ্যাকাররা এই কয়েন ব্যবহার করছে। ফলে তাদের পরিচয় গোপন থাকছে। সরকারি নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সাধারণ মানুষের টাকার দুর্নীতি হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। তাই অনেকদেশই এই ক্রিপ্টোকারেন্সিতে ব্যান লাগিয়েছে। বাংলাদেশে এই লেনদেন করতে ধরা পড়লে তাদের বিরুদ্ধে আইনি কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে, প্রথমে বিশ্বের নানা দেশের সরকার এটি থেকে বিমুখ থাকলেও ধীরে ধীরে নরম মনোভাব প্রকাশ করছে।
কীভাবে ইনভেস্ট করবেন ও কীভাবে কম সময়ে আপনিও নিজের সম্পত্তি কয়েকগুন বাড়িয়ে ফেলতে পারেন ?
দ্বিতীয় পর্বে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।
Business Idea : কম খরচ ও কম জায়গায় শুরু করা এই ব্যবসা দেবে বড় লাভ