Tuesday, December 10, 2024
More

    ফ্রান্সের সাম্রাজ্যের সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট হিরো না ভিলেন ?

    রিন্টু ব্রহ্ম

    তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে সাহসী সামরিক কমান্ডারদের মধ্যে একজন, ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী মহারাজা। আবার তিনিই ছিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত শাসকদের মধ্যে একজন। একদিকে ক্ষমতার লোভে অংখ্য যুদ্ধ করে প্রাণ নিয়েছেন বহু মানুষের। অন্যদিকে দেশের নাগরিকদের মঙ্গলে করেছেন একাধিক ভালো কাজ। হ্যাঁ, তিনি হলেন নেপোলিয়ন। ফ্রান্সের সাম্রাজ্যের সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। তিনি কি সত্যিই জনদরদি ছিলেন ? না ছিলেন অত্যাচারী, হিটলারের পূর্বসূরী একনায়ক ? কীভাবেই বা তিনি একের পর এক যুদ্ধে পরাস্ত করেছেন শক্তিশালী বিপক্ষকে ? 

সমস্ত দিকগুলিই আলোচনা করা হবে এই লেখায়।

    হলিউড পরিচালক রিডলি স্কটের নতুন ছবি ‘নেপোলিয়ন’ সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে ২৪ নভেম্বর। তিনি সেই পরিচালক যিনি গ্ল্যাডিয়েটর, দ্য মার্টিয়ান এবং ম্যাথিউ-এর মতো চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন। তারপরেই ফের বিশ্বব্যাপী চর্চায় নেপোলিয়ন বোনাপার্টের জীবন।

    ১৭৬৯ সালে ফরাসি আর্মি কর্সিকা দখল করে। এর কয়েক মাস পরে কর্সিকাতেই ১৫ আগস্ট নেপোলিয়নের জন্ম হয়। নেপোলিয়নের বাবা কার্লো ছিলেন একজন আইনজীবী, যিনি নিজে কর্সিকার স্বাধীনতার জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাথে লড়াই করছিলেন। কিন্তু পরে ফরাসি রাজাদের পক্ষে গিয়ে তাঁদের হয়ে কাজ শুরু করেন। তাঁর বাবার সাহায্যেই বৃত্তি পেয়ে নেপোলিয়ন ফরাসি সামরিক কলেজে ভর্তি হন। তাঁর স্বপ্ন ছিল একদিন তাঁর দেশ কর্সিকাকে স্বাধীন করার। একাডেমিতে তাঁর আগ্রহ ছিল ফরাসি নৌবাহিনীতে যোগদানের, কিন্তু তিনি সেনাবাহিনীর অস্ত্র বিভাগে নিযুক্তি পান। কিছু সময়ের মধ্যেই সেনাবাহিনীতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসাবে পদোন্নতি লাভ করেন। যেহেতু ফরাসি বিপ্লবের সময় সংঘটিত সমস্ত বড় যুদ্ধগুলি স্থলভাগেই সংঘটিত হয়েছিল, তাই নেপোলিয়ন তাঁর সামরিক কৌশলগত দক্ষতা দেখানোর যথেষ্ট সুযোগ পান। ফ্রান্সের একটি বন্দর নগরী থেকে ব্রিটিশ নৌসেনাকে উৎখাত করার দায়িত্ব পান। মাত্র সামান্য কিছু সৈন্য নিয়ে রণকৌশল ও আবেগ দিয়ে লড়াই করে যুদ্ধে জেতেন তিনি। এরপর ফ্রান্সের আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনের দায়িত্বও সাফল্যের সঙ্গে পালন করেন। প্রকাশ্য রাজপথে অংখ্য মানুষের ওপর কামান দেগে জনপ্রিয়তা পান নেপোলিয়ন।

    ১৭৯৮ সালে নেপোলিয়ন মিশরে সামরিক অভিযানের জন্য রওনা হন। মিশরীয় অভিযান শেষ হতে না হতেই তিনি সেনাবাহিনীকে ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু সেই সময় তিনি এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে তারপরেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। শহরে পৌঁছতেই ফ্রান্সের জনগণ তাঁকে ঘিরে উল্লাস প্রকাশ করতে থাকে। পরে তিনি ইতালি জয় করার পর রাজতন্ত্রের অবসান করে সেখানেও ফ্রান্সের মতো একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ইতালীয় সামরিক অভিযানের পর নেপোলিয়ন আর পিছনে ফিরে তাকাননি। ফ্রান্সে ফেরার পর ফরাসি জনতা তাকে বীর হিসেবে স্বাগত জানায়। একের পর এক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সাফল্য অর্জন করেন। এক সময়, সেনাবাহিনীতে মাঝারি উচ্চতার লোকটিকে দেখে সৈন্যরা নীরব সুরে তার উচ্চতা নিয়ে মজা করেছিল। কিন্তু নতুন জেনারেলের আবেগঘন বক্তৃতা এবং আক্রমণের পূর্ণ পরিকল্পনা শুনে তারা শীঘ্রই বুঝতে পেরেছিল যে তাদের সামনে কোন সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে নেই।

    এই নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ছিলেন বিশ্বের সেরা সামরিক কমান্ডারদের একজন। নেপোলিয়ন প্রায়সময় গুপ্তচর নিয়োগ করে শত্রুপক্ষের গোপন খবর রাখতেন এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। সারা জীবনে তিনি প্রায় ৮০-র বেশি যুদ্ধ লড়ে ছিলেন। যার মধ্যেই পরাজিত হয়েছিলেন মাত্র হাতে গোণা কয়েকটি যুদ্ধে। সেই সময় ইংল্যান্ড ছাড়া প্রায় সমগ্র ইউরোপ তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল। নেপোলিয়নের দ্বারা পরিচালিত যুদ্ধ এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর সাহসী আন্দোলন এবং আশ্চর্যজনক সামরিক কৌশলগুলি এখনও সারা বিশ্বের সামরিক একাডেমিগুলিতে পড়ানো হয়। অসাধারণ দক্ষ প্রশাসকের পরিচয়ও দিয়ে দিয়েছেন তিনি। ইউরোপে তথা ফ্রান্সের বেসামাল রাজনৈতিক অবস্থা থেকে তিনিই প্রথম ফ্রান্সে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। অর্থনীতি, আইনি ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য সংস্কার করেন। গির্জা, সামরিক, শিক্ষা এবং সরকার পরিচালনায় একাধিক সদর্থক পরিবর্তন আনেন। জনগণের জীবন-যাপনেরও মান উন্নয়ন হয়।

    ১৮০২ সালে ফরাসি আজীবন কনস্যুলেট পদে নিযুক্ত হন তিনি। পরে তিনি এতটাই জনসমর্থন পেয়েছিলেন যে, ১৮০৪ সালে তিনি নিজেই মাথায় মুকুট পরে নিজেকে ফ্রান্সের সম্রাট ঘোষণা করেন। এরপর টানা ৮ বছর তিনি প্রবল জন সমর্থন নিয়ে দেশ পরিচালনা করেন।তবে উত্তরাধিকারী নিয়ে চিন্তায় পড়েন তিনি। সন্তান না হওয়ায় প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দেন। ১৮১০ সালে তিনি অস্ট্রিয়ার রাজকন্যা ম্যারি লুইকে বিয়ে করেন। এবং পুত্র সন্তানের জন্ম দেন।

    অন্যদিকে সেই সময় তিনি একেরপর এক যুদ্ধে মেতে থাকেন। ১৮১০ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ড বাদে প্রায় সমগ্র ইউরোপ দখল করে ফেলেন বা নিজের আয়ত্বে আনেন। রাশিয়া, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, স্পেন, জার্মানি, পোল্যান্ড ও ব্যালকনকে নিজের হাতের মুঠোয় করে ফেলেন। নেপোলিয়ন রাশিয়ার সম্রাট আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে ১৮১২ সালে ৬ লক্ষ সৈন্য নিয়ে মস্কো অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার শীত যখন হিমাঙ্কের নীচে তখন মস্কোর কাছে বোরাডিনের রণাঙ্গনে উভয় পক্ষের তুমুল যুদ্ধ হয়। নেপোলিয়ন জয়লাভ করলেও তার সৈন্য ও সঞ্চিত রসদের বিপুল ক্ষতি হয়। এদিকে প্রচণ্ড শীত ও খাদ্যাভাবে নেপোলিয়নের সৈন্যরা চরম দুর্দশার মধ্যে পড়ে। রাশিয়ার সেনা পাল্টা হামলায় চালায়। শেষে মাত্র ৫০,০০০ সেনা নিয়ে প্যারিসে ফেরেন তিনি।

    ১৮১৪-তে অস্ট্রিয়া, গ্রেট ব্রিটেন, প্রুশিয়া, রাশিয়া, সুইডেন এবং পর্তুগাল অর্থাৎ মিত্র শক্তিরা একত্র হামলা করে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস দখল করে। ফলে তিনি সিংহাসন ত্যাগ করে ভূমধ্যসাগরের এলবা দ্বীপে চলে যান।

    নেপোলিয়নের নির্বাসনের ফলে ফ্রান্সে চতুর্দশ লুইয়ের ভাই অষ্টাদশ লুইকে সিংহাসনে বসায় মিত্রশক্তি। পরে নেপোলিয়ন ফের সৈন্যদের নিজেদের পক্ষে করে প্যারিসে প্রত্যাবর্তন করে দ্বিতীয়বারের মতো আবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ২০ মার্চ, ১৮১৫-তে এলবার নির্বাসন থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর প্যারিসে এসেছিলেন ৮ জুলাই, ১৮১৫। যেই সংগ্রাম ফরাসি ইতিহাসে ‘হানড্রেড ডে’ নামেও পরিচিত। 

নেপোলিয়নের সিংহাসনে পুনঃ দখলের কথা শুনে মিত্র বাহিনী আবার নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে এগিয়ে আসে। নেপোলিয়নও অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে শেষবারের মতো লক্ষাধিক সৈন্য জোগাড় করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু ১৮১৫-তে বিখ্যাত ওয়াটারলু যুদ্ধে সম্মিলিত প্রুশিয়া ও ইংরেজ বাহিনীর কাছে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হন। এটিই ছিল তাঁর জীবনের শেষ যুদ্ধ। এবার নেপোলিয়নকে ৫০০০ মাইল দূরে মধ্য আটলান্টিক মহাসাগরের দুর্গম ‘সেন্ট হেলেনা’ দ্বীপে নির্বাসন পাঠানো হয়। এই স্থানেই ৬ বছর অতিবাহিত করার পর ১৮২১ সালে পেটের ক্যানসারে শক্তিশালী বীরের জীবনাবসান হয়।

    Read more How to Join NSG: কীভাবে যোগ দেবেন NSG-তে ? জানুন বিস্তারিত

    Diptiprakash Dey
    Diptiprakash Deyhttps://www.bonglifeandmore.com
    With over 12 years of dedicated journalism experience, Diptiprakash Dey joined the role of Journalist at Bartaman Patrika, And also earned a Doctorate degree in Bengali from The University of Burdwan, Mr. Diptiprakash bring a deep understanding of media dynamics to work. From 2 years He have embarked on a new journey with Bonglifeandmore.com, where his aim to cover and report verious newses.

    Related Articles

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

    Stay Connected

    3,541FansLike
    3,210FollowersFollow
    2,141FollowersFollow
    2,034SubscribersSubscribe
    - Advertisement -

    Latest Articles