সুপর্ণা দাস ও রিমা মণ্ডল
ডাক্তারিতে ভর্তির প্রবেশিকা পরীক্ষা যা NEET নামে পরিচিত। সেই NEET Scam-এর বিরুদ্ধে উত্তাল হয়েছে গোটা দেশ। উঠে এসেছে একেরপর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। উঠে এসেছে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতির তত্ব। কিন্তু কীভাবে সম্ভব হল এই দুর্নীতি ? কারা কারা জড়িত এই ঘটনায় ? কেন্দ্রীয় সরকার কি কিছুই জানত না ? জানুন পুরো ঘটনা
দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগগুলি কী কী ?
এবছর গত ৫ মে সর্বভারতীয় মেডিকেল প্রবেশিকা (NEET -UG) সারা দেশজুড়ে আয়োজন করা হয়। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার একই দিনে গত ৪ জুন যখন সারা দেশের নজর লোকসভা নির্বাচনের ফলের দিকে তখনই প্রকাশ পায় নিট এর ফল, যা প্রায় নির্ধারিত সময়ের ১০ দিন আগে। ফলাফল ঘোষণার পর দেখা গিয়েছে এবারের NEET – এ মোট ৬৭ জন পরীক্ষার্থী ১০০ শতাংশ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে। একেবারে বিশ্ব রেকর্ড, ৬৭ জন প্রথম স্থানে, তাও আবার ভারতের অন্যতম কঠিন পরীক্ষায়। আশ্চর্যজনকভাবে ৬৭ জনই ফুল মার্কস পেয়েছে। একদম ৭২০-তে ৭২০। ভাবুন একবার!
এর পাশাপাশি অন্য আরেক যে প্রশ্নটা উঠে , কীভাবে নিটে মোট নম্বর ৭২০ এর মধ্যে ৭১৯ বা ৭১৮ নম্বর পেতে পারে পরীক্ষার্থী ? কারণ নিটে মোট ১৮০ টি প্রশ্ন থাকে। প্রতি প্রশ্নে সঠিক উত্তর অনুযায়ী ৪ নম্বর করে পেয়ে থাকে ছাত্রছাত্রীরা। একটি প্রশ্ন ভুল হলে ৪ নম্বর কাটা যায়। কেউ ১৮০ টি প্রশ্নের সঠিক উত্তর লিখলে ৭২০ নম্বর পাবে। আবার কেউ ১৭৯ টি ঠিক লেখে তাহলে সে পাবে ৭১৬। এইরকম প্রশ্নপত্র ধাঁচ অনুযায়ী ৭২০-র পর সর্বোচ্চ নম্বর হতে পারে ৭১৬। সেখানে নিট এর খাতায় ৭১৮ ও ৭১৯ পাওয়ার কথা নয় পরীক্ষার্থীদের।
শুধু তাই নয়, হরিয়ানার একটি সেন্টার থেকেই প্রথম হয়েছে ৬ জন, কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব ? দেখা গেছে যে ৬৭ জন ৭২০ নম্বর পেয়েছে। এমনকি, হরিয়ানার একটি পরীক্ষা কেন্দ্রের ৬ জন সেই তালিকায় রয়েছেন। একে নিছকই কাকতালীয় ঘটনা বলে মানতে নারাজ অধিকাংশ পরীক্ষার্থীরা।
এখানেই শেষ নয়, ১৫৬৩ জন পরীক্ষার্থীকে অতিরিক্ত গ্রেস মার্কস দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যেখানে পরীক্ষা কেন্দ্রে বিভিন্ন কারণে পড়ুয়াদের সময় নষ্ট হওয়ায় তাঁদের এই গ্রেস মার্কস দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। যদিও এই নিয়ম নিয়ে বহু অভিযোগ তোলে পরীক্ষার্থীরা। ফলে চাপে পড়ে এনটি এর তরফ থেকে গ্রেস মার্কস প্রাপ্ত ১৫৬৩ জনের মার্কশিট বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাড়তি নম্বর বাতিলের পর ১৫৬৩ জনকে নিয়ে ফের নিট হয় রবিবার। –
NEET – এর ফলাফল নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ করে কংগ্রেস সহ একাধিক বিরোধীদল। এই নিয়ে মামলা সুপ্রিম কোর্ট অবধি পৌছায়। জনস্বার্থে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন ‘ফিজিক্সওয়ালা’ নামে অনলাইন কোচিং প্লাটফর্মের প্রতিষ্ঠাতা অলোক পাণ্ডে।
একাধিক সংবাদ মাধ্যমে খবর করা হয়েছে, পরীক্ষা শুরুর আগে থেকেই নাকি জালিয়াতির অভিযোগ উঠতে শুরু করে। পরীক্ষার দুদিন আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় ও প্রশ্নর ছবি ঘুরতে দেখা গিয়েছে ও এমনকি ডার্ক ওয়েবেও খোলামেলাভাবে বিক্রি করা হয়েছে নিটের প্রশ্নপত্র।
ভিডিয়োর তৈরি পর্যন্ত মোট ১৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। সারা দেশজুড়ে একাধিক দুর্নীতির জালের সূত্র মিলেছে তদন্তকারীদের। যার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। মাত্র কয়েকদিনের দু’ তিনটি রাজ্যে তদন্তে নেমে প্রাথমিকভাবে ৬০–৭০ কোটি লেনদেনের ইঙ্গিত পেয়েছে পুলিশ। বিহারের ইকোনমিক অফেন্স ইউনিট পরীক্ষার্থী ও অভিভাবক সহ ১৩ জনকে গ্রেফতার করে। তদন্তে ৫০ লক্ষ টাকায় প্রশ্নপত্রের কেনা–বেচা হয়েছ বলে জানায় পুলিশ। ইন্ডিয়া টুডে-র কাছে বিজেন্দ্র নামে এক অভিযুক্ত স্টিং অপারেশনে দাবি করেছেন, নিটের প্রশ্ন ফাঁস করে ২০০-৩০০ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্য ছিল চক্রীদের। এর জন্য বাছা হয়েছিল ৭০০ পরীক্ষার্থীকে।
কেস গেল সিবিআইয়ের হাতে –
- নিট প্রশ্ন ফাঁস কাণ্ডে ইতিমধ্যেই তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিবিআইকে। প্রশ্ন ফাঁস দুর্নীতিতে বিহার, গুজরাত ও রাজস্থান পুলিশ যে পাঁচটি অভিযোগ দায়ের করেছে, সেই মামলা হাতে নেয় সিবিআই।
অন্য দিকে, নিট-এর প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ইডি তদন্ত চেয়ে একটি আবেদন জমা পড়েছে সুপ্রিম কোর্টে।
পুলিশ ও সিবিাআই-য়ের তদন্তে উঠে আসে সলভার গ্যাঙ্গের নাম। পাটনায় সঞ্জিব মুখিয়া নামে ব্যক্তি এই গ্যাং -এর কিনপিন বলে মনে করছে সিবিআই। মুখিয়ারা, পড়ুয়াদের সঙ্গে ৩০ থেকে ৪০ লক্ষ টাকায় রফা করত। ১০০০ টাকার স্ট্যাম্প পেপারে করা হত প্রশ্নপত্র বিক্রির চুক্তি পত্র। ঠিক জায়গা-জমি কেনার মতো। সেখানে সব পক্ষের সই থাকত। টাকা নেওয়া হত চেক। যেখানে ডাক্তার, নামী ব্যক্তি সহ প্রভাবশালীরা জড়িত থাকত বলে জানা গিয়েছে। যা করা হয়েছিল পরিকল্পনা মাফিক। ৪৮ ঘণ্টা আগেই ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল প্রশ্ন। এছাড়াও উঠে এসেছে কিছু কোচিং সেন্টারের নাম।
আরও অভিযোগ ওঠে, নিট পরীক্ষার এক দিন আগে পটনা এবং রাঁচীতে লার্ন প্লে স্কুল অ্যান্ড বয়েজ় হস্টেলে ডাক্তারি পড়ুয়াদের নিয়ে আসেন সঞ্জীব। ওই লার্ন প্লে স্কুল অ্যান্ড বয়েজ় হস্টেলে আগে থেকেই পরীক্ষার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন সঞ্জীব। সেখানেই তাঁদের প্রশ্ন এবং উত্তরপত্র বিলি করা হয় লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে।
* প্রশ্ন ফাঁসে বিহার যোগ
পরীক্ষার দিন পটনার বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে প্রশ্নের ফোটোকপি বিলি করার অভিযোগ পায় পুলিশ। শাস্ত্রীনগরে একটি পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরে ঝাড়খণ্ডের নম্বরপ্লেট যুক্ত একটি গাড়ি থেকে অনেক অ্যাডমিট কার্ড উদ্ধার করে পুলিশ। ৪ জন পড়ুয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পারে, তাঁরা আগের দিনই প্রশ্নপত্র পেয়ে গিয়েছিলেন! এর পরেই ‘সিট’ গঠন করে তদন্তে নামে পটনা পুলিশ। একটি সূত্রের দাবি করা হয়, পরীক্ষার দিন কয়েক আগে ৬০ কোটি টাকার বিনিময়ে উত্তরপ্রদেশ থেকে প্রশ্ন ‘কিনে’ বিহারে নিয়ে আসে একদল পরীক্ষা-মাফিয়া। ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
* প্রশ্ন ফাঁসে সেই গুজরাটের গোধারা
২০০২-এ মোদীর মুখ্যমন্ত্রিত্বের গোড়ার দিকে দাঙ্গার কারণে শিরোনামে উঠে আসা গোধরা এ বারে নিট-কেলেঙ্কারির দৌলতেও ফের শিরোনামে। সেখানকার জয় জলরাম স্কুলে পরীক্ষা দেওয়া ৩০ জন সন্দেহের তালিকায় বলে জানিয়েছে পুলিশ। যাঁদের মধ্যে অনেকেই ভিন্ রাজ্যের পড়ুয়া। সন্দেহ করা হচ্ছে, ওই পরীক্ষা কেন্দ্রের পরীক্ষকদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি কোচিং সেন্টার এই দুর্নীতি করেছে।
ঝাড়খণ্ড থেকেও প্রশ্ন ফাঁস
তদন্তে নেমে হাজারিবাগের ওয়েসিস স্কুল থেকে পাওয়া যায় পোড়া প্রশ্নপত্র। পোড়া প্রশ্নের সিরিয়াল কোড থেকে তদন্তকারীরা স্পষ্ট হন। সেখান থেকেও কোনওভাবে প্রশ্ন ফাঁস হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এদিন পোড়া প্রশ্ন পত্র উদ্ধারের ঘটনার সত্যতা সংবাদ মাধ্যমের কাছে স্বীকার করে নেন ওই স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল। তবে, তিনি এও দাবি করেন সমস্ত নিয়ম মেনে প্রটোকল ফলো করেই প্রশ্নপত্র তথা বুকলেট বক্স খোলা হয়েছিল।
চারিদিকে শুরু হয় আন্দোলন
দেশব্যাপী শুরু হয় আন্দোলন। দিল্লি সহ বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে নামে পড়ুয়া ও ছাত্র সংগঠনগুলি। এর আঁচ গিয়ে পড়ে সংসদেও। তৃতীয়বারের এনডিএ সরকারের প্রথম অধিবেশন শুরুর দিনেই নিটে বিপুল দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ দেখান বিরোধীরা। সত্যিই তো এর দায় তো কেন্দ্রে থাকা সরকারের ওপরই বর্তায়। এত বড় দুর্নীতি যখন হচ্ছিল তখনকি দেশের চৌকিদার ঘুমোচ্ছিলেন ? “না খায়ুঙ্গা না খানে-দুঙ্গা” বলে সরকারে এসেছিল মোদী। কিন্তু দেখুন যে রাজ্যগুলিতে এই স্কামের খবর পাওয়া যাচ্ছে, গুজরাট, বিহার, হরিয়ানা, সব রাজ্যে মোদির লোকজন। ৬০-৬৫ লাখ করে পরীক্ষার্থীদের থেকে নেওয়া হয়েছে। এতে সরকারের সাপোর্ট না থাকলে এতবড় দুর্নীতি করা এক-দুজনের পক্ষে করা সম্ভব নয়। সঞ্জিব মুখিয়া বা বাকি কয়েকজন, যাদের নাম আসছে সেগুলি চুনোপুটি। এর পিছনে বড় রাঘব বোয়াল আছে। সমস্যাটা হল, NTA এবং CBI দুটোই মোদী নির্ভর। কীভাবে এর নিরপেক্ষ তদন্ত হবে ? সুপ্রিম কোর্টে SIT গঠন করে সর্বোচ্চ আদালতের নজরদারিতে এর তদন্ত হওয়া দরকার।
সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশ
নিট মামলায় ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি বা এনটিএ-কে নোটিস দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। পরীক্ষা বাতিলের আর্জিও জানানো হয়েছিল সুপ্রিম আদালতে। এই নিয়ে এনটিএ কী ভাবছে, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। এনটিএ-র জবাবের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ করতে সুপ্রিমকোর্ট। তার আগে জানিয়ে রাখি আগামী ৬ জুলাই নিট-র কাউন্সেলিং এর ডেটও রয়েছে।
পরীক্ষা বাতিলের দাবি
ডাক্তারিতে ভর্তির দায়িত্ব রাজ্যের হাতে ছাড়ার দাবিতে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে চিঠি দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। চিঠিতে নিট-এর মাধ্যমে ডাক্তারিতে ভর্তির বর্তমান যে ব্যবস্থা, তাকে দ্রুত বাতিল করার পাশাপাশি রাজ্যগুলির হাতে পরীক্ষা আয়োজনের দায়িত্ব তুলে দেওয়ার অনুরোধও জানিয়েছেন
শেষে বলা যায়
এই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার ফলে ছাত্রছাত্রীদের ভরসা গিয়ে ঠেকেছে তলানিতে। দেশের ৭০০ টি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির আসায় ২৪ লক্ষ পরীক্ষার্থী নিট দিয়েছেন। তাঁদের ভবিষ্যৎ এখন কি হবে সেটাই বড় প্রশ্ন।
যারা ঋণ নিয়ে কোচিং-এর ফি দিয়েছিল ? যারা চাষের টাকায় শহরে পড়তে গিয়েছিল ? যারা বছরের পর বছর পরিশ্রম করেছিল তাঁদের ভবিষ্যৎ কি ? প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। তবে, ছাত্রছাত্রীদের কাছে আমাদের বার্তা ভেঙে না পড়ে মনকে শক্ত করতে হবে। সকলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেলে সকলেই ন্যায় পাবেন।
Read more Fact check: ১ জুলাই থেকে বনগাঁ লোকসভায় অন্নপূর্ণা ভাণ্ডার চালু করেছে বিজেপি ? এটি ফেক নিউজ