কুস্তি ফেডারেশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে কুস্তিগিররা
শর্মিষ্ঠা ঘোষ
রাতে গাড়ি ছুটছে নেহেরু স্টেডিয়ামের দিকে। চলছে জোরালো আন্দোলনে। ভারতের কুস্তি ফেডারেশনের বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করা কুস্তিগিররা। তাঁদের ক্ষোভ কুস্তি ফেডারেশন ও ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ব্রিজভূষণ শরণ সিংহের বিরুদ্ধে। যৌন নির্যাতন সহ দীর্ঘদিন ধরে একাধিক ও সঠিক পরিকাঠামো না পাওয়া ও স্বজন পোষণ সহ প্রতিটা ক্ষেত্রেই রয়েছে একাধিক অভিযোগ।
অলিম্পিক্স, এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমসে মেডেল জয়ী সাক্ষী মালিক, ভিনেস ফোগত ও বজরঙ্গ পুনিয়ারা কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে আন্দোলনে নেমেছেন। প্রায় ১৪ দিন ধরে দিল্লির যন্তর-মন্তরে চলছে তাঁদের এই লড়াই। এর মধ্যেই বুধবার রাতে আন্দোলনকারীদের ওপর দিল্লির পুলিশ লাঠি চালাতে শুরু করে বলে অভিযোগ। শুধু তাই নয়, মদ্যপ অবস্থায় পুরুষ পুলিশরা মহিলা কুস্তিগীরদের ওপর আক্রমণ করেছে বলে অভিযোগ। যে দেশের জন্য রক্ত জল করে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে মেডেল এনেছিলেন সেখানেই এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে কুস্তিগিরিদের। কুস্তিগির ভিনেশ ফোগত ও সাক্ষি মালিক এরকম ব্যবহারে হতগ্রস্ত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “এই ব্যবহার পাওয়ার জন্যই কি দেশের জন্য পদক নিয়ে এসেছিলাম”?
কুস্তি ফেডারেশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে পাশে দাঁড়িয়েছেন তারকা কুস্তিগিররা। কিন্তু কুস্তিগিরদের অভিযোগ কি ?
বর্তমানে দিল্লিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন কুস্তিগিররা। বিক্ষোভ মঞ্চ থেকে ভিনেশ ফোগত বলেন, “ব্রিজভূষণ শরন সিং ও ফেডারেশন আমাকে মানসিকভাবে অপদস্থ করেছে। আমার ওপর প্রচুর চাপ সৃষ্টি করত। এছাড়াও আমরা যখন টোকিও অলিম্পিক্সে গিয়েছিলাম, তখন আমাকে কোন ফিজিও দেওয়া হয়নি। সবাই জানে উনি কতটা শক্তিশালী। উনি বিজেপির চারবারের সাংসদ। ওনার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ জানাতে গেলে, উনি খুনের হুমকি দেন”। তিনি এও বলেন, “আমাদের অনেক মহিলা কুস্তিগির যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছে। তাছাড়াও ব্রিজভূষণ কুস্তিগিরদের ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশ করার চেষ্টাও করতেন।” অন্যদিকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ বজরং পুনিয়া গণমাধ্যমে বলেন, “সারা দেশের মানুষকে আমাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। আমি সরকারকে অনুরোধ করব আমাদের সব পদক ফিরিয়ে নেওয়া হোক”। এদিন কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্তার প্রতিবাদে প্রাক্তন ক্রিকেটার অনিল কুম্বলে বলেন, “কুস্তিগিরদের মারধরের ঘটনায় আমি রীতিমতো হতাশ। সুষ্ঠুভাবে যে কোন সমস্যা সমাধান করা যায়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা এর প্রতিকারে আশা চাইছি”। এছাড়াও অভিনব বিন্দ্রা, সুনীল ছেত্রী, বীরেন্দ্র সিংহের মতো নামী ক্রীড়াবিদরা এই হেনস্থার শিকার কুস্তিগিরদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে।
আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় গঙ্গায় বিসর্জন
সেই ঘটনার পরে মঙ্গলবার কুস্তিগীররা এক হয়ে তাঁদের অর্জন করা মেডেল গঙ্গায় বিসর্জন দিতে যান। এদিন হরিদ্বারের গঙ্গায় পদক বিসর্জন দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁরা। সরকারকে ৫ দিনের জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার সময়সীমা দেন।
গঙ্গায় বিসর্জনের কারণ কী ?
জানাজায়, বিখ্যাত বক্সার মহম্মদ আলী ১৯৬০ সালে অলিম্পিক্সে প্রথম সোনা জয় করেছিলেন। ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ওরফে মহম্মদ আলী। গোটা আমেরিকার হিরো তিনি। একসময় ক্যাসিয়াস একটি রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে রেস্তোরাঁর শ্বেতাঙ্গ মালিক তাঁর গায়ের রং কালো হওয়ার কারণে তাকে খাবার দিতে অস্বীকার করে। যার ফলে বর্ণবিদ্বেষে জর্জরিত হয়ে ক্ষোভে, দুঃখে, যন্ত্রণায়, তার দেশের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে পাওয়া সোনার মেডেলটি ওহাইও নদীতে বিসর্জন দেন।
ঠিক সেই পদক্ষেপ অবলম্বন করে ভারতীয় স্বর্ণপদকজয়ী কুস্তিগিররা। তারাও তাঁদের জীবনের অন্যতম মূল্যবান মেডেলগুলিকে ভাসিয়ে দিতে যান মা গঙ্গার কাছে। সবশেষে বলা যায়, যারা কঠিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে ব্যস্ত, যারা বিদেশে গিয়ে দেশের হয়ে পতাকা উড়িয়ে আসে, সেই কুস্তিগীরদের যৌন হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। এটাই কি আমাদের সেই ভারতবর্ষ যেখানে “বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও” এর মত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প রয়েছে?
কী বলছেন অভিযুক্ত ব্রিজভূষণ সিং ?
ব্রিজভূষণ বলেন, ‘ওঁরা হরিদ্বারে গিয়েছিলেন গঙ্গায় পদক বিসর্জন দিতে। সেগুলো কৃষকনেতাদের হাতে তুলে দিয়ে ফিরে এলেন। ওঁদের সিদ্ধান্ত। কিছু বলার নেই।’ এরপর তিনি বলেন, ‘ঘটনার তদন্ত করছে পুলিশ। আমার বিরুদ্ধে যদি কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় তা হলে আমাকে গ্রেপ্তার করবে পুলিশ।’
ব্রিজভূষণ আরও বলেন, “যদি আমার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও প্রমাণিত হয়, তাহলে আত্মহত্যা করব। আমার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ থাকলে আদালতে পেশ করুন। যেকোনও শাস্তি মেনে নিতে প্রস্তুত!’ উল্লেখ্য, ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হলেও, তাঁকে এখনই গ্রেপ্তার করছে না দিল্লি পুলিশ। বুধবার দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে, ব্রিজভূষণকে গ্রেপ্তার করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কুস্তিগিররা যে দাবি করছেন, তার স্বপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ নেই।”
আরও পড়ুন