বিশ্বের সব থেকে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। ফুটবল পছন্দ করেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষের কাছে ফুটবল আর ফুটবলার দের নিয়ে গভীর উন্মাদনা। ফুটবলের ইতিহাসে সেরা খেলোয়াড়দের তালিকা ঘাটলে, ফ্রান্স এর তারকা ফুটবলার জিনেদিন জিদান এর নাম এক বাক্যেই উঠে আসবে। তার প্রতিভার দৌরাত্ম্য বিশ্ব ফুটবলের আগামী প্রজন্মের অনুপ্রেরণা । বিশ্বকাপের মঞ্চে জিদানের শেষ ম্যাচ ফুটবলপ্রেমীদের কাছে আজও বিতর্কের বীজ বুনতে সক্ষম। ম্যাচের শেষ লগ্নে রেড কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল জিদান কে। এই ঘটনায় রেফারি হোরেশিও আলেজান্দ্রোকে অনেক সমালোচনার মুখাপেক্ষী হতে হয়েছে। কিন্তু এই ঘটনার নেপথ্যের কাহানি কি ছিলো তাই জানান দেবো আজ।
১৯৩০ সাল থেকে ফিফা প্রতি চার বছর অন্তর বিশ্বের সেরা দল গুলিকে নিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজন করে। ফিফার আয়োজিত বিশ্বকাপ বিশ্বব্যাপি ফুটবলপ্রেমীদের উন্মাদনার পারদ শিখরে নিয়ে যায়। সারা বিশ্বে ফুটবলপ্রেমীদের কাছে বিশ্বকাপ কোনো উৎসব থেকের কম নয়। এই বিশ্বকাপের মঞ্চে পুরনো রেকর্ড ভাঙ্গে ,তৈরী হয় নতুন নজির। কেউ হয় হিরো, কেউ ভোগে হতাশায়।
‘জিনেদিন জিদান’ বিশ্ব ফুটবলে এই নাম আমাদের কাছে সকলের কাছেই পরিচিত। ১৯৯৪ সালে ফ্রান্সের হয়ে জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন জিদান। তার প্রতিভা তাকে জাতীয় দলে স্থায়ী স্থান করে দেয়। এরপর আসে ১৯৯৮ সাল। বিশ্বকাপের মঞ্চে ফ্রান্স এর হয়ে এক তীক্ষ্ণ মিড ফিল্ডার এর ভুমিকায় অবতীর্ণ হয় জিদান। এটা ছিলো তার প্রথম বিশ্বকাপ। দলের নৈপুণ্যতা ফ্রান্স কে ফাইনালে জায়গা করে দেয়। এবার ছিলো জিদানের পালা। ফাইনালে ব্রাজিলের বিরূদ্ধে জোড়া গোল করে রাতারাতি ফুটবল দুনিয়ার হিরো হয়ে যায় জিদান। এবছরই তাকে ‘ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার’ তকমা দেওয়া হয়। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি। একের পর এক খেতাব নিজের দখলে করে জিদান। ফুটবলার হিসেবে তিন বার ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলার, ও একটি ব্যালন ডি অর রয়েছে তার সাফল্যের ঝুলিতে।
২০০৬ সালের বিশ্বকাপ জিদান সহ সমগ্র ফুটবল অনুরাগীদের কাছে আজও স্মরণীয় । এটাই ছিলো জিদানের ফুটবল কেরিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ। যার সমাপ্তি হয়েছিলো ফাইনাল ম্যাচে। জিদানের দক্ষতায় সেবার ফ্রান্স দল ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছিল। ৯’ই জুলাই বার্লিনের অলিম্পিয়া স্টেডিয়ামে ফ্রান্স আর ইতালির মধ্যে বিশ্বকাপের ফাইনাল। একদিকে ফ্রান্সের জিদান অন্যদিকে ইতালির মার্কো মাতারাজ্জি। দুটো দেশ নয় দুই প্লেয়ার এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের ময়দান ছিলো এই ফাইনাল। খেলা শুরু হওয়ার ৭ মিনিটের মধ্যে পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। জিদানের পা আবার জ্বলে ওঠে। ইতালির দুর্গ রক্ষক বুফন কে পরাস্ত করে জিদান। ফ্রান্সের স্কোর সীট ১-০ তে এগিয়ে যায়। কিন্তু এই খুশি বেশিক্ষনের জন্য ছিলো না। মাত্র ১৯ মিনিটের মাথায় ইতালির হয়ে মার্কো মাতারাজ্জি গোল পরিশোধ করে দেন। গোটা ম্যাচে আর গোল আসেনি কোনো তরফেই। খেলা যখন প্রায় শেষ লগ্নে তখনই ঘটে বিপত্তি। জিদান দেখেন লাল কার্ড।
২০০৬ এর বিশ্বকাপ ফাইনালে রেফারির ভুমিকায় ছিলেন আর্জেন্টিনার হোরেশিও আলেজান্দ্রো। সঙ্গে সহকারী রেফারি হিসেবে আসেন ডারিও গার্সিয়া ও রুডালফো আটারো। বিশ্বকাপে রেফরির ভুমিকায় এটি ছিল তাদের পঞ্চম ম্যাচ। গোটা ম্যাচ দারুন ভাবে পরিচালনা করছিলেন তারা। কিন্তু অন্যদিকে গোল পেতে মরিয়া ছিল দু দলই। খেলা অতিরিক্ত সময়ে এগোলেও ফ্রান্স ও ইতালি কেউই ম্যাচ উইনিং গোল তখনও পায় নি। খেলা শেষ হওয়ায় ১০ মিনিট আগে ঘটে বিশ্বকাপের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা।ভিডিও রিপ্লে তে দেখা যায় মাতারাজ্জি ও জিদান ইতালির পেনাল্টি এরিয়ার পাশে দাড়িয়ে। দুজনকে অল্প সময়ের জন্য কথা বলতে দেখা যায়। এরপর জিদান সেখান থেকে পা ফেলে চলে যেতে শুরু করেন। দুই কদম এগিয়েই আবার ঘুরে দাড়ান। তারপর অসম্ভব জোরে মাথা দিয়ে মাতারাজ্জির বুক বরাবর আঘাত করেন। মাতারাজ্জি ওখানেই পড়ে যান। বিশ্বকাপ ফাইনালের মত এতো বড়ো ম্যাচে এরকম ঘটনা আগে কেউ দেখেনি। সেই মুহুর্তে জিদানের এই কাণ্ড ম্যাচ রেফারির চোখ এড়িয়ে যায়। কিন্তু মাতারাজ্জিকে পড়ে থাকতে দেখে রেফারি ঘটনার বিবরণ জানতে চান। এরপর ভিডিও রিপ্লে দেখে হোরেশিও আলেজান্দ্রো সরাসরি রেড কার্ড দেখান জিদান কে। জিদানের রেড কার্ডে ইতালির জয় সুনিশ্চিত হয়ে যায়। খেলার মূল পর্ব ১-১ গোলে ড্র থাকায় পেনাল্টি শুট আউটে বিশ্বখেতাব ইতালির দখলে আসে।
এখানেই শুরু হয় বিতর্ক। ম্যাচের দিন জিদানের এই কাণ্ড সেই মুহূর্তে চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল তিন জন রেফারির। তা সত্বেও রেড কার্ড দেখানো হয়েছিল জিদানকে। এই প্রসঙ্গে রেফারি নিজেই তার স্বীকারত্তি দেন। তিনি বলেন “আমি প্রায় চোখ বন্ধ করেই এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম। কারন আমি তো নিজের চোখে ঘটনাটা দেখিনি। আমি যখন খেলা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত দিলাম তখন দেখলাম মাতারাজ্জি উঠে দাঁড়াচ্ছেনা। আমি তখন চিন্তিত হয়ে গেলাম, আমি ভাবছিলাম কি হয়েছে! যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে আমি সেখান থেকে ২৫-৩০ মিটার দুরে ছিলাম। আমি ঘটনাস্থলে দৌড়ে যাই। আমার সহকারী রেফারি ডারিও কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি কিছু দেখেছেন? ডারিও জানালেন, তিনি কিছুই দেখেননি। আরেক সহকর্মী রেফরি রুডালফো বললেন, তিনিও কিছুই দেখেননি। তখনই আমি ৪র্থ জন লুইচ মেডিনার গলা শুনলাম। তিনি বলছিলেন, মারাত্বক গুতো মেরেছে, মারাত্বক গুতো! আমি বললাম, বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমাকে বলুন কিভাবে এটা ঘটেছে। ওদের দুজনের কি মাথায় মাথায় ধাক্কা লেগেছিল? লুইস মেডিনা বললেন, না, আমি শুধু জিদানকেই ওর মাথা দিয়ে গুতো মারতে দেখেছি, আপনি আজ হোটেলে গিয়ে ঘটনাটি ভিডিওতে দেখতে পারেন, আপনি নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারবেন না।”
মাঠে আবার নামারআগেই হোরেশিও তার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন। তার এই সিদ্ধান্ত গ্যালারী তে উপস্থিত হাজার হাজার দর্শকের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে জেনেও তিনি রেড কার্ডে মাঠ ছাড়তে বাধ্য করেন জিদানকে। ফুটবলের ইতিহাসে এই ঘটনা বিরল। জিনেদিন জিদান সেদিন বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে ট্রফি ছাড়াই বিদায় নিয়েছিলেন। কিন্তু সফলতা তার পিছন ছাড়েনি। খেলোয়াড় হিসেবে যেমন অসাধারণ প্রতিভা দেখিয়ে মণ জয় করেছিলেন ফুটবল প্রেমীদের , তেমনই একের পর এক পুরস্কার তার আগামী ভবিষ্যতের রাস্তা খুলে দিয়েছিল। খেলোয়াড় থেকে এখন কোচের ভূমিকায় জিদান সর্বাপেক্ষা সফল। ২০১৭ ফিফা বেস্ট মেল কোচ অ্যাওয়ার্ড এ ভূষিত হয়েছেন তিনি। তার নেতৃত্বে রিয়াল মাদ্রিদ তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগ দুবার ইউ এফ এ সুপার কাপ এবং একবার লা লিগা চ্যাম্পিয়ন হয়। দারিদ্রতা, লাঞ্ছনা, অসহায়তাকে হাতিয়ার করে জিরো থেকে হিরো হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণার নাম জিনেদিন জিদান। ফুটবল অনুরাগী দের কাছে জিদান এক জীবন্ত কিংবদন্তি।