অনুন্নত গ্রামের আদিবাসী কন্যা গোলাপী বাস্কের প্রতিভায় পঞ্চমুখ দেশবাসী। রাজধানী শহর দিল্লিতে ক্রিকেটের ভগবান শচীন এবং বলিউড তারকা আয়ুষ্মান খুরানার মতো তারকার সাথে ফুটবল খেলেছে গোলাপী, সৌজন্যে ইউনিসেফ। পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রাম, উচ্চবিত্ত নয়, সেখানে আদিবাসীদের বসবাস, মানুষের পেশা দিনমজুরি। খেটে খাওয়া গরীব মানুষগুলির কাছে খেলাধূলা শুধু বিলাসিতা মাত্র। এদেরই মধ্যে চারজনের এক ছোট্ট পরিবার। বাবা মারা গেছে বছর তিনেক হল, সংসারে এখন মানুষ বলতে মা আর তিন বোন। সেই পরিবারের মেয়ে গোলাপী বাস্কে। দিন আনা দিন খাওয়া পরিবার, সংসার টানতে মা করেন দিনমজুরি। সংসারের কাজ সামলে গোলাপী হাত লাগতো মায়ের কাজে। কিন্তু এটা তার পরিচয় নয়, ফুটবলের গায়ে পা লাগিয়ে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন তার। সেই সুত্রেই আজ পুরুলিয়া থেকে নাম ছড়িয়েছে আজ দেশের রাজধানী দিল্লিতে। একই ফ্রেমেবন্দি হয়েছেন প্রাক্তন ক্রিকেটার শচিনের সাথে।
পাড়ার ছেলেদের হাত ধরেই গোলাপী ফুটবলের মাঠে পা রাখে। খেলার মাঠ তৈরির জন্য লোকের কাছে কোনও সময় চেয়ে-চিন্তে, আবার কখনো কিছু জমি কিনে স্বপ্নের প্রথম ধাপটা পেরিয়েছে। সময় কাটাতে কাটাতে একসময় অজান্তেই ফুটবল তার ভালোবাসায় পরিণত হয়। গোলাপী ম্যাচ খেলতে নামে, একের পর এক ট্রফির সাথে ছিনিয়ে নেয় হজার হাজার দর্শকের মন। গ্রামের দল থেকে জেলার টিমে নাম ওঠে তার। ফুটবল মাঠে মিড ফিল্ডের দক্ষতা তার অনুশীলনের সফলতার পরিচয় দেয়।
এর মধ্যে এমন একটা ঘটনা ঘটে যা সে কল্পনাও করতে পারেনি। হটাৎ ইউনিসেফের একটি দল আসে পুঞ্চার পাকবিররা অঞ্চলে। সেখানেই গোলাপীর খেলা মুগ্ধ করে সকলকে। শহুরে জাক জমক আর লাইম লাইটের আলো থেকে বহুদূরের গ্রামাঞ্চলে লুকিয়ে থাকা প্রতিভাকে চিনতে দেরি করেনি ইউনিসেফের প্রতিনিধিরা। তাকে সিলেক্ট করা হয় রাজধানী শহরে একটি ফুটসল ইভেন্টের জন্য।
আন্তর্জাতিক শিশু দিবসের দিন দিল্লির ত্যাগরাজ স্টেডিয়ামে ইউনিসেফ আয়োজন করে একটি ইন্ডোর ফুটবল ম্যাচ। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের খুদে খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠিত হয়েছিল দুটি দল। যার একটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ক্রিকেটের ভগবান শচীন তেন্ডুলকার, এবং অন্যটিতে বিখ্যাত বলিউড তারকা আয়ুষ্মান খুরানা। গ্রামের এক অতি দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা গোলাপীর খুশির অন্ত ছিল না। জীবনে প্রথম বার ফুটবলের দৌলতে সে শচিন এর মুখোমুখি হবে। সঙ্গে থাকবে আয়ুষ্মান খুরানাও। এই অভিজ্ঞতা সে নিজের মুখেই বলেছে সকলকে। গোলাপীর কোচ দয়াময় মাহাতর সঙ্গে গোলাপী পৌঁছায় ত্যাগরাজ স্টেডিয়ামে।
অতঃপর খেলা শুরু হয়, এখানেও অনড় গোলাপী। একদিকে গোল করে অন্যদিকে ট্যাকেল। তার প্রতিভা সকলকে মুগ্ধ করলেও শচিনের দলের কাছে শেষ মেশ হার মানতে হয় তাদের। ফলাফল হয় ২-২ । গোলাপী এদিকে হেরেও জয়ী। জীবনে প্রথম বার সে এতো বড় তারকাকে ছুঁয়ে দেখল, অনুপ্রানিত হল। আগামী ভবিষ্যতের দিকে আর এক পা বাড়ানোর সুযোগ পেল। তার স্বপ্নের উড়ানে এ এক সুন্দর প্রাপ্তি।
খেলার মাঠে শচিনের বিপক্ষে খেলার অনুভূতি গোলাপীর গলায় স্পষ্ট, “শচীনের পা থেকে বলও কেড়েছি। দু-একবার পড়েও গিয়েছি। সরি বলতেই বলেছেন, না না ঠিক আছে। এত ভাল লেগেছে বলে বোঝাতে পারব না। শুধু অটোগ্রাফ নয়, খেলার পরে আমার জার্সিতেও সই করে দিয়েছেন। জীবনের সব চেয়ে বড় পাওনা হয়ে রয়ে যাবে এই অভিজ্ঞতা। যখন পুরুলিয়া জেলা টিম এবং আন্তঃজেলা ফুটবল টুর্মামেন্টে খেলতাম, তখনও ভাবিনি এই দিনটি আসবে। আমার মা এবং দুই বোন সবসময়েই আমায় ফুটবলে উৎসাহ দিয়েছেন। আজ তা সফল হল।”
গোলাপী বাস্কে একজন অনুপ্রেরণা আমাদের সকলের কাছে। প্রতিকূল পরিস্থিতি তার লক্ষে বাধা হতে পারেনি। বরং অভাব, অনটন, কে অস্ত্র করে ফুটবলই তার জীবন গড়ছে। আজ শুধু পুরুলিয়া নয়। সমগ্র রাজ্যসহ দেশবাসীও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।