মানব সভ্যতায় মানবতা আজও কি সমাজে প্রতিষ্ঠা হয়েছে! নানা দেশে নানা সময়ে ধর্ম, রাজনীতি ও বর্ণ বৈষম্যর নামে চলেছে যুদ্ধ। রক্তক্ষয়, হিংসা, মৃত্যু, গণহত্যা। নিষ্পাপ শিশু খুন। ধর্ষণ। যার সম্পূর্ণ উল্টোদিকে জন্মনিয়েছে মানবতার দর্শন। দার্শনিকরা কল্পনা করেছেন এমন সমাজ যেখানে কোনও বিভেদ থাকবে না। কারুর কোনও ধর্ম নেই। কেউ অচ্ছ্যুত নয়। সাদা-কালো গায়ের রঙ দেখে বিভেদ নয়। সম্পত্তি নিয়ে হিংসা নেই। অপরাধ নেই। শ্রেণি শোষণ নেই। মানবতাই একমাত্র ধর্ম-কর্ম। শুনতে সত্যিই অবাস্তব, কাল্পনিক স্বপ্নের মতো হয়ত। এমন সমাজ গড়া কোনও দিনই বাস্ততে সম্ভব নয় বলেই মনেকরেন সকলে। কিন্তু আমাদের দেশের তামিলনাডু রাজ্যেই রয়েছে এমন একটি সমাজ। চেন্নাই থেকে ১৫০ কিমির মধ্যে ভিল্লুপুরম জেলার এই শহরের নাম ‘অরোভিল’ (Auroville)। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের থেকে আসা কয়েকহাজার বাসিন্দারা এখানে এসে বহু বছর ধরে বসবাস করছে। নারী, পুরুষ কিংবা জাতিগত বিভেদ তো নেইই। কারুর পরিচয়ের সঙ্গে নেই কোনও ধর্ম। এমনকি ব্যক্তিগতভাবে কেউ কোনও সম্পত্তির মালিক নন। শহরের ঘর-বাড়ি, দোকান, কারখানা সকল সম্পত্তির মালিক সেখানের বাসিন্দারাই। প্রচলন নেই টাকারও। টাকা ছাড়াই সকলে ভালোবেসে একে অপরের জন্য পরিষেবা দিয়ে থাকে। সকলেই নিজের ক্ষমতা ও পারদর্শীতার উপর কাজ করে। একে অপরের প্রতি বিশ্বাসই মূলধন। বিশ্বমানবতার দর্শনেই বিশ্বাসী সেখানের নাগরিকরা। ভারতের মতো ভিন্ন ভাষা-ধর্ম-বর্ণ-জাতির দেশেই ১৯৬৮ সালে তৈরি হওয়া থেকে বিশ্ববাসির কাছে আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থার এক অনন্য নজির হয়েছে ‘অরোভিল’।

২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীর প্রায় ৬০টি দেশের প্রায় ৩০০০ নাগরিক এখানের স্থায়ী বাসিন্দা। থাকে শিশুরাও। বহু পরিবার এখান থেকেই তৈরি হয়েছে। বহু শিশু এখানেই বেড়ে উঠছে। খেলার মাঠে একসঙ্গে বহু শিশু খেলা করে। যাদের মাতৃভাষা আলাদা, গায়ের রঙ, চুলের রঙ, ধর্ম আলাদা। চোখ মেলেই শিখছে বিশ্বমানবতার পাঠ। পেশা হিসাবেও কেউ ছোট-বড় নয় এখানে। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়র-শিক্ষক কিংবা সাফাই কর্মী, সকলকেই একই সম্মানের সঙ্গে বাঁচেন। কেউ কোনও টাকার বিনিময়ে এখানে শ্রম বা পণ্য লেনদেন করে না। সবটাই হয় একে অপরকে ভালোবেসে। সকলের মাইনে এক। মাসে ১২০০০ টাকা। থাকা খাওয়ার জন্য কাউকে কোনও খরচ করতে হয় না। সবটাই যোগান দেয় অরোভিল কর্তৃপক্ষ। জানাযায়, ‘অরোভিল’ নামটির উৎপত্তি ফরাসী শব্দ ‘অরোর’ (Aurore) থেকে। যার অর্থ ‘ভোর’। তাই অরোভিলকে ‘ভোরের শহর’(City of Dawn) বলাও হয়। এছাড়াও অনেকের মতে শহরটির নাম হয়েছে দার্শনিক ও বাঙালি আধ্যাত্মিক গুরু যোগী শ্রী অরবিন্দর নাম থেকে। তাঁর ফরাসী বংশোদ্ভুত সহকারী মীরা আলফাসা এই শহর তৈরি করেন ‘মডেল’ সমাজ গড়ার লক্ষ্যে।
কীভাবে তৈরি হল ?
জেলে থাকাকালীন ঋষি অরবিন্দ ঘোষের বিশেষ চিন্তাভাবনার উন্মোচন হয়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি পন্ডিচেরিতে গিয়ে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে তিনি নিজেই অন্তরালে চলে যান। সামনে থেকে সব কাজ পরিচালনা করেন তাঁর শিষ্যা মীরা আলফাসা। যিনি ‘শ্রী মা’ নামে পরিচিত হন। ১৯৩০ থেকে ১৯৬০ এর মধ্যেই এই অরোভিল তৈরির চিন্তাভাবনা শুরু করেন ‘শ্রী মা’। ১৯৬০-এ ‘মা’ তাঁদের এমন সমাজের শহরের পরিকল্পনার কথা ভারত সরকারের কাছে জানান। ১৯৬৫ সালে তিনি বিবৃতিতে জানান, “অরোভিল একটি সর্বজনীন শহর হতে চায়। যেখানে ধর্ম-বর্ণ-রাজনীতি-জাতীয়তা নির্বিশেষে সকল দেশের নারী ও পুরুষ শান্তি ও প্রগতির সঙ্গে বাস করবে”। ততকালীন ভারত সরকার এই নিয়ে খুবই আগ্রহী হয়ে ওঠে। ১৯৬৬-তে ইউনেস্কোতে এই শহর তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়। সেখান থেকেও সম্পূর্ণ সবুজ সংকেত পাওয়া যায়।

sree-aurobinda-and-mother-শ্রী-অরবিন্দ-ও-শ্রী-মা
১৯৬৮-র ২৮ ফেব্রুয়ারি বুধবার ‘শ্রী মা’ ভারতের প্রতিটি রাজ্যের, বিশ্বের ১২৪ টি দেশের প্রতিনিধিসহ ৫০০০ জনের উপস্থিতিতে নগরীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। প্রত্যেক প্রতিনিধি নিজ নিজ দেশের মাতৃভূমির একমুঠো মাটি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। সবার জন্মভূমির মাটি একত্রে মিশ্রিত করে একটি সাদা মার্বেলে তৈরি কমলা কলসে রাখা হয়। অরোভিল শহরে জীবনযাপনের জন্য ‘শ্রী মা’ যে দৃষ্টিভঙ্গি স্থির করে ছিলেন তা ফরাসি ভাষায় নিজের হাতে লিখে ৪ দফা সনদের আকারে পেশ করেন।

বলাহয়, ‘অরোভিল’ কারুর একার নয়। সমগ্র মানবজাতির। কিন্তু কেউ এখানের বাসিন্দা হতে চাইলে, তাঁকে অবশ্যই স্বর্গীয় চেতনাবোধের স্বেচ্ছাসেবক হতে হবে। এটি হবে অফুরন্ত শিক্ষা। অবিরাম প্রগতি ও শাশ্বত তারুণ্যের জন্য নির্দিষ্ট একটি স্থান। অরোভিল অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে একটি সেতু হতে চায়। প্রকৃত মানব ঐক্যের মূর্ত প্রতিরূপের জন্য পার্থিব ও আত্মিক গবেষণার একটি স্থান হবে।
মহাবিশ্বের প্রতীক হিসাবে ১৪০০টি সোনার প্রলেপ দেওয়া বড়বড় চাকতি দিয়ে এক স্বর্ণ-গোলক তৈরি করা হয়। যা মাতৃমন্দির নামে পরিচিত। মাতৃমন্দিরের আশেপাশের অঞ্চলটি শান্তির অঞ্চল। যেখানে চেতনা হওয়ার জন্য শুধু ধ্যান ও যোগ করা হয়। কোনও দেব-দেবীর মূর্তি পুজো নয়। আজকের দিনে এটি পৃথিবীর একমাত্র শহর যেখানে মানবতা প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজ নিয়ে এমন পরীক্ষা চলছে।
শহর পরিকাঠামো ও বিস্তার
নগরীর পরিকল্পনা ও স্থাপন করেছিলেন রজার অ্যাঙ্গার নামের এক ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট। শহরের বাইরের দিকে আছে প্রশস্ত এলাকা জুড়ে সবুজ গাছপালা পরিবেষ্টিত ‘গ্রিন বেল্ট’। গোলাকার শহরের চারিদিক সবুজ বনে ঘেরা। এই স্থান পরিবেশ গবেষণার কাজে ও প্রাকৃতিক সম্পদ অঞ্চল হিসাবে ব্যবহৃত। খামার, বনজ সম্পদ, খাদ্য, ভেষজ উদ্ভিদ পরিবেষ্টিত অংশ। মাঝে রয়েছে কেন্দ্র। যাকে ঘিরে রয়েছে একেকটি অঞ্চল। আবাসিক অঞ্চল, শিল্প অঞ্চল, সাংস্কৃতিক(ও শিক্ষা) অঞ্চল ও আন্তর্জাতিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে শহর। অভ্যন্তর ভাগেও নগর ও নিসর্গের মেলবন্ধনের ব্যবস্থা।

রয়েছে স্কুল, হাসপাতাল, খেলার মাঠ। সামান্য কিছু প্রয়োজন ছাড়া বাইরে থেকে কিছুই আমদানি করতে হয় না। জ্বালানি বিদ্যুৎ নয়। সমগ্র শহর চলে সৌর বিদ্যুৎ থেকে। সোলার সিস্টেম থেকে প্রতিদিনের রান্না হয়। পানীয় হল অপচয় রুখতে বাসিন্দারা প্রতিদিন মাত্র ৫০ লিটার জল ব্যবহার করে থাকেন। পরিবহনের জন্য রয়েছে নিজস্ব বাস ও অন্য যান পরিষেবা।
টাকা ব্যবহার হয় না অরোভিলে
তাহলে প্রথমে মনে হবে যেখানে তথাকথিত আমাদের আধুনিক সমাজ টাকার বিনিময়েই সমস্ত পরিষেবা থেকে সুবিধা বা পণ্য লেনদেন করা হয় সেখানে কীভাবে তাঁরা টাকা ছাড়া জীবনযাপন করছেন। আসলে তাঁরা একটি বিকল্প অর্থনীতি তৈরি করে ফেলেছে। প্রাচীনকালে যেমন সেবার বদলে সেবা দিয়ে মানুষ মূল্য মেটাত। ঠিক তেমনই। নাগরিকরা প্রতিনিয়ত নানা কাজ করে থাকেন বা সেবা দিয়ে থাকেন। যা তাঁদের মাসিক খাতায় জমা হয়। তা থেকেই তাঁরা সেবার বিনিমনে সেবা পান। এছাড়াও সবার নামে আলাদা অ্যাকাউন্ট থাকে। তাঁদের একটি ফিনান্সিয়াল সার্ভিস সেন্টার থেকে গোটা প্রক্রিয়া পরিচালনা হয়। ভিতরেই রয়েছে ২০০ বেশি বাণিজ্যিক কেন্দ্র। যেখান থেকে অ্যাকাউন্টে লেনদেন করা হয়। এখানে যেই পর্যটকরা আসেন তাঁদেরও বলা হয় এখানে অ্যাকাউন্ট করে লেনদেন করতে। তাঁদের অর্থরাশি নিয়ে অরোকার্ডে জমা করা হয়। বাসিন্দারা বিভিন্ন কাজ করে থাকেন। বন থেকে ও এলাকা থেকে প্রাকৃতিক উপাদান নিয়ে নানা খাবার ও পণ্য উৎপাদন করা হয়। বাইরে তা বিক্রি করে অরোভিলের উন্নতির জন্য জমা করা হয়। নাগরিকরা কর্মের বিনিময়ে সামান্য অর্থ থেকে থাকে। যদিও অরোভিলে তাঁদের কিছু খরচের প্রয়োজন পড়ে না। সবই হয় কেন্দ্রিয় তহবিলে।
প্রথমে এখানের অরোভিল কর্তৃপক্ষই সমস্ত অর্থ ও আইন-প্রশাসন দেখাশোনা করত। কিন্তু একেকসময় একেক সমস্যার জন্য ভারত সরকার এই দিকগুলি দেখাশোনা করেন। অরোভিল ফাউন্ডেশন বাণিজ্যিকভাবে পণ্য বিক্রি করে যা লাভ করে থাকে তা থেকে এখানের ঘর নির্মাণ, গেস্টহাউস নির্মাণ, স্কুল রক্ষণাবেক্ষণার কাজে লাগানো হয়। তাছাড়া এখানের একটা বড় অর্থ সাহায্য আসে বিশ্বের নানা দেশ ও সংস্থা থেকে।
বাসিন্দাদের জীবনযাপন
বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছে ফরাসী, রাশিয়ান,
আমেরিকান, জার্মান, ব্রিটিশ, ইসরায়েলি, মেক্সিকান, চিনা, জাপানি, শ্রীলঙ্কান, নেপালী, আইসল্যান্ডিক, চেক, ডাচ, ব্রাজিলিয়ান, আর্জেন্টাইন সহ আরও অনেক দেশের বাসিন্দারা। পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তের মানুষই আছে এই শহরে। অরোভিলে ৫০ হাজার মানুষের বাসস্থানের ব্যবস্থা আছে। ছোট থেকে বড় হওয়া অবধি এখানেই রয়েছে স্কুল, রিসার্চ ইনিস্টিউট, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও শারীরশিক্ষা কেন্দ্র।

বাসিন্দাদের সাংস্কৃতিক উন্নতির জন্য রয়েছে সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র, নাচ, গান, আঁকা, কবিতা, নাটক, ফটোগ্রাফি ও হস্তশিল্প শেখার একাধিক কেন্দ্র। যাতে বাসিন্দাদের মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশও ঘটে। রয়েছে নিজস্ব স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ও জরুরি চিকিৎসার কেন্দ্র। মহিলাদের কাজের জন্য মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী। তাছাড়া সব মরশুমেই লেগে থাকে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিনোদনের ব্যবস্থা। প্রতি শনিবার করে রাতে আয়োজন হয় ‘পিজ্জা নাইট’। মাত্র ২০০ টাকায় যত খুশি পিজ্জা খেতে পারেন আপনিও।

সঙ্গে শামিল হতে পারেন নাচের অনুষ্ঠানও। পর্যটকদের জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। প্রতি বছর প্রায় ৫০০০ পর্যটক অরোভিল দেখতে আসে।
কর্তৃপক্ষের দাবি, এখানে কখনও কোনও রকম অপরাধমূলক কোনও ঘটনাই ঘটে না। প্রায় একেবারে শূন্য অপরাধমূলক ঘটনার সংখ্যা। নিষিদ্ধ মদ্যপান।
আগামী দিনে বিশ্বমানবতার পথকে আরও অরোভিল আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা।