প্রধানত পুরীর নিজস্ব ঘরানার উৎসব হওয়া সত্ত্বেও শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রা (Rath Yatra) তথা রথদ্বিতীয়া উৎসবপ্রিয় বাঙালির মনেও আলাদা উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। কথিত আছে, দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনে প্রত্যাবর্তনকে স্মরণ করেই রথযাত্রার সূচনা। যে সকল ভক্ত তাঁর কাছে আসতে পারেন না, তাদের দর্শন দিতে প্রভু জগন্নাথ স্বয়ং মন্দিরের গর্ভগৃহ ছেড়ে বেরিয়ে এসে ভক্তকে দর্শন দেন এই দিনে। মাহেশ, গুপ্তিপাড়া ও মহিষাদলের প্রসিদ্ধ রথযাত্রার মতো চৈতন্যধাম নবদ্বীপও রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের দিক থেকে কোনও অংশে পিছিয়ে নেই। ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’—কবির এই বার্তার যেন সঠিক মান রেখেছে একদা ‘অক্সফোর্ড অফ বেঙ্গল’ নবদ্বীপ। নবদ্বীপে যে ক’টি অতি প্রাচীন রথ যুগ যুগ ধরে সম্প্রীতির বার্তা বহন করে চলেছে, তার মধ্যে দ্বিতীয় অন্যতম প্রাচীন নবদ্বীপের মণিপুর পুরাতন রাজবাড়ির রথ। যার প্রধান বিশেষত্ব, জগন্নাথদেব যান না মাসির বাড়ি। রথে থাকেন একাই। থাকেন না তাঁর ভাই-বোন। এছাড়াও রয়েছে নানান রীতিনীতি। আনুমানিক প্রায় তিন শতাব্দী ধরে পালিত হয়ে আসছে এই রথযাত্রা। যেখানে শুধু স্থানীয়রাই নন, প্রতিবছর রথযাত্রায় সামিল হতে সুদূর মণিপুর থেকেও আসেন বহু ভক্ত।
শহরের দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত এই মণিপুর রাজবাড়ি ও তৎসংলগ্ন শ্রীশ্রীঅনুমহাপ্রভু মন্দির। ‘নবদ্বীপে মণিপুর রাজবাড়ি’—শুনতে আশ্চর্য লাগলেও, এর উত্তর পেতে ওল্টাতে হবে ইতিহাসের পাতা। সময়টা ১৭৯৮। মণিপুররাজ ‘রাজর্ষি’ ভাগ্যচন্দ্র, কন্যা রাজকুমারী বিম্বাবতী দেবীকে নিয়ে নবদ্বীপে আসেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন মণিপুরে তৈরি কাঁঠাল কাঠ নির্মিত মহাপ্রভুর অপূর্ব দারু বিগ্রহ। বিগ্রহের নির্মাণে মণিপুরী শৈলীর প্রভাব সুস্পষ্ট। নদিয়ার রাজ সিংহাসনে তখন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র মহারাজ ঈশ্বরচন্দ্র। তিনিই মন্দিরকল্পে জমি দান করেন। প্রায় ১০ বিঘা জমির উপরে বর্তমান এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন মহারাজা ভাগ্যচন্দ্রের পুত্র রাজকুমার চৌরজিৎ সিংহ। কথিত আছে, মণিপুরে ভাগ্যচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত শ্রীগোবিন্দ বিগ্রহ রাজকুমারী বিম্বাবতীকে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মূর্তি তৈরির স্বপ্নাদেশ দেন। স্বপ্নে দেখা রূপের আদলেই এই মূর্তি তৈরি করা হয়। শ্রীগোবিন্দের অনুমতি নিয়ে এই মহাপ্রভু মূর্তি নির্মিত হয় বলে বিগ্রহের নাম অনুমহাপ্রভু। সেই থেকে বংশপরম্পরায় শ্রীশ্রীঅনুমহাপ্রভুর পুজো হয়ে আসছে। এরপর রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্রের মৃত্যুর পর রাজকুমার চৌরজিৎ সিংহ বোন বিম্বাবতী দেবীর ইচ্ছানুসারে নবদ্বীপে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে নবদ্বীপের মণিপুর রাজবাড়ির রথের সূচনা হয়। রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে হরিনাম সংকীর্তন, খোল-করতাল, কাঁসরঘণ্টা ও উলুধ্বনি সহযোগে ভক্তসমাগমে নবদ্বীপের পথে পথে ঘুরে রথ আবার রাজবাড়িতেই ফিরে আসে। তবে এখানে পুরীর মতো মাসির বাড়ির প্রথা নেই। মণিপুর রাজবাড়ির রথের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, রথে শুধুমাত্র শ্রীজগন্নাথদেব উপবিষ্ট থাকেন, সুভদ্রা এবং বলরাম সেখানে অনুপস্থিত। স্বল্প যাত্রাপথে এই রথ বিভিন্ন স্থানে থামে এবং সেখানে ভক্তদের তরফ থেকে প্রভু জগন্নাথদেবকে আরতি ও ভোগ নিবেদন করা হয়।
এব্যাপারে রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র মহারাজার বংশধর তথা শ্রীশ্রীঅনুমহাপ্রভু সেবায়েত সমিতির সেক্রেটারি রাজকুমার টিকেন্দ্রজিৎ সিংহ জানান, “আগে অনেক জাঁকজমক সহকারে রথযাত্রা হতো। তখন সোজা রথ থেকে উল্টো রথ অবধি প্রতিদিন প্রায় তিন-চারশো ভক্ত প্রসাদ গ্রহণ করতেন। পরবর্তীতে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে এই রীতির পরিবর্তন ঘটে। গত ৭-৮ বছর ধরে প্রতিদিনের সেই খিচুড়ি-পরমান্ন ভোগের জাঁকজমকতা এখন বন্ধ। বর্তমানে শুধুমাত্র রথের প্রথম ও শেষ দিন প্রসাদ বিতরণের ব্যবস্থা রাখা হয়।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উল্টো রথ অবধি রথের ক’দিন নাটমন্দিরে কবি জয়দেবের দশাবতার স্তোত্র পাঠ ও ভজন-কীর্তন গাওয়া হয়। প্রথা মতো এই বছরেও তার ব্যতিক্রম হবেনা।
বর্তমানে ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধির কথা মাথায় রেখেই গত বছরের ন্যায় এবছরেও রথের চাকা গড়াচ্ছে না বলে জানালেন রাজকুমার টিকেন্দ্রজিৎ সিংহ। এদিন মন্দির প্রাঙ্গনেই শ্রীজগন্নাথ বিগ্রহকে পুজো করে আবার মন্দিরে রেখে দেওয়া হয়। স্বাভাবিকভাবেই রথযাত্রার অনাড়ম্বর আয়োজন ও সর্বোপরি রথের রশিতে টান দেওয়ার ‘পুণ্যলাভ’ থেকে এবারেও ভক্তদের বঞ্চিতই হতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন
Jagannath Deb Snan Yatra 2021: রথযাত্রার প্রাক্কালে পুরীতে অনুষ্ঠিত হল জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা