ভারতের সুপ্রাচীন ইতিহাসে সময়ে সময়ে অনেক মনীষী জন্মেছেন যারা বিশ্ব দরবারে ভারতকে স্বর্ণস্থানে বসিয়েছে। ভারত আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে ভারতের এই সাফল্যের কান্ডারীদের মধ্যে এমন একজন ছিলেন যাঁকে সুদক্ষ পন্ডিত, লেখক, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, অর্থনীতিবিদ, শক্তিশালী নেতা, নারী মুক্তিদাতা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাতা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা, রাষ্ট্রবিপ্লবী ও বৌদ্ধ পুনর্জাগরণবাদী রূপে পরিচয় দেওয়া যায়, তিনি হলেন ডক্টর ভিমরাও রামজি আম্বেদকর। যার অন্যতম পরিচয় আমাদের সংবিধানের জনক রুপে। আজকের দিনেই বাবাসাহেবের মহাপরিনির্বান ঘটে। অনুরাগীদের কাছে আজও এই ঘটনা বিতর্কের। ভীমরাও আম্বেদকর এমন এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন যিনি জন্মেছিলেন হিন্দু হয়ে কিন্তু মৃত্যুবরণ করেন বৌদ্ধ ধর্মে। তবে মহাপুরুষের মৃত্যু হয় না তাই তিনি সংবিধানের মধ্যে দিয়ে আমাদের অদৃশ্যেই সকলকে রক্ষা করে যাচ্ছেন।
মহারাষ্ট্রের রত্নাগিরির মাটিতে জন্মে ছিলেন ভিমরাও রামজি আম্বেদকর। সমাজে দলিত সম্প্রদায়ে জন্মানোর ফলে উচুঁ জাতির মানুষরা তাঁর ছায়া দেখাও অশুভ বলে মনে করত। এইভাবেই চরম অপমান, লাঞ্ছনা, বহিষ্কার, ত্যাগ এর মধ্যে দিয়ে তার বড়ো হয়ে ওঠার গল্প কমবেশি আমরা সকলেই শুনেছি। শিক্ষাকে বেচেঁ থাকার হাতিয়ার করে পরে শিক্ষিত সমাজকেই শিক্ষা দিয়েছিলেন আম্বেদকর।
নীচু জাতির হওয়ায় ক্লাসরুমের বাইরে বসেই প্রাথমিক শিক্ষাস্তর উত্তীর্ণ করেছেন। বরদার মহারাজ সায়া জি গায়কোয়ার্ড তার অভাব আর মেধা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি স্কলারশিপের ব্যাবস্থা করে দেন। স্কলারশিপের ফলে তৎকালীন বোম্বাইতে তিনি পলিটিকাল সায়েন্স ও ইকোনমিকস নিয়ে গ্রাজুয়েট পাশ করেন। এখানে জীবনের একটা অধ্যায় শেষ ও অন্য অধ্যায়ের সুচনা।
সমাজের অপমান তখনও তার পিছু ছাড়েনি। নিজেকে সবার থেকে আলাদা করতে গ্রাজুয়েট পাশ করে ছুটে যান বিদেশ। স্কলারশিপের টাকায় পৌঁছে যান নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে। এবার আরও উচুঁতে লক্ষ্য করে চালিয়ে যান পড়াশোনা। একের পর এক ডিগ্রি তার জ্ঞান ভান্ডার তাকে শান্ত করতে পারেনি, একটা শেষ তো আর একটা শুরু। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে এভাবেই প্রথমে এম.এ করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস, ও সমাজবিজ্ঞান নিয়ে; তারপর পি এইচ ডি। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির পড়াশোনা এখানেই শেষ হয়। এরপর তিনি পৌঁছে যান লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে। এখানে তিনি প্রথম এম.এস.সি করেন এরপর ল বা আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং নিজের ডক্টরেট ডিগ্রী সম্পন্ন করেন।
জীবন কালে তিনি একাধিক বই লিখেছেন। আমাদের সংবিধানের খসড়াও তার হাত দিয়ে তৈরি। সমাজের দলিত সম্প্রদায়কে তিনি সমাজে প্রকৃত স্থান দিয়েছিলেন। এই সমাজের নারীদের প্রকৃত মুক্তিদাতা তিনি। সমাজের প্রতিটি মানুষের জন্য তিনি তিনটি উক্তি রেখে গিয়েছেন। ‘শিক্ষিত হও, সংঘটিত হও, আন্দোলন করো।’ তাঁর অনুরাগীরা আজও এই বাক্য যথাযথ পালন করে।
সংবিধান রচনাকালে অত্যাধিক চাপের কারণে তিনি সুগার আক্রান্ত হন,রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। শারীরিক অসুস্থতার কারণে আজকের দিনে অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর তার মহাপরিনির্বাণ ঘটে। আজও বেশ কিছু অনুরাগী তাঁর মৃত্যুকে স্বাভাবিক না ভেবে হত্যা মনে করেন। তারা বাবাসাহেব আম্বেদকরের হত্যার দায়ী করেন তার স্ত্রী সবিতা আম্বেদকর কে। পন্ডিত জহরলাল নেহেরু তৎকালীন একটি কমিটি গঠন করেছিলেন যাতে এই মৃত্যুর রহস্য উন্মোচন করা যায়। কমিটি সবিতা আম্বেদকর কে নির্দোষ প্রমাণ করে। কিন্তু তাতেও বিতর্ক শান্ত হয়নি।
অসহায় দলিত মানুষদের জন্য লড়াই করতে করতে জ্ঞানচক্ষুর উদয় হয়েছিল আম্বেদকরের। সস্ত্রীক দীক্ষা নিয়েছিলেন বৌদ্ধ ধর্মে। সমাজের নিচু মানুষগুলোকে উঁচু জাতের মানুষদের সমকক্ষ করে তুলতে তার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। স্বাধীনতার আন্দোলনে সমাজের নিচু জাতির মানুষগুলোকে তুলে আনতে কখনো গান্ধীজীর সাথে বিতর্কে জড়িয়েছেন আবার কখনো হয়েছেন তার প্রিয় মুখ। তবে স্বাধীনতার পর আম্বেদকর এর দায়িত্ব বেড়ে যায় বহু গুনে। সংবিধান সজ্জার মূল দায়িত্ব পান তিনি। অত্যাধিক চাপে যখন শরীর ভেঙে পড়ে তখন তার হাত ধরেন স্ত্রী সবিতা আম্বেদকর। নির্লস প্রচেষ্টায় এক এক করে সম্পূর্ণ সংবিধান সাজিয়ে তোলেন আম্বেদকর। জীবনের এই সময়ে তিনি রচনা করেন তার শেষ বই “দ্যা বুদ্ধা এন্ড হিস ধর্ম।”
ডক্টর বি আর আম্বেদকর “দ্য এভলিউশন অফ প্রভিনশনাল ফিনান্স ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া” এবং “দ্য প্রবলেম অফ দা রুপি” নামক অর্থনীতির বিষয়ে দুটি বই লেখেন যে বই দুটির তত্ত্বের ওপর রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়াও তিনি ‘ওয়েটিং ফর ভিসা’ নামক একটি বই রচনা করেন যা আজও কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি পাঠ্যপুস্তক। আরও অনেক বই ও চিঠি রয়েছে যার মধ্যে “আনটাচেবেলস অর দ্যা চিল্ড্রেন অফ ইন্ডিয়াস চিত্ত” অন্যতম।
“দ্যা বুদ্ধাএন্ড হিস ধর্মা” গ্রন্থটিই ছিল তার লেখা শেষ বই । এই বইটি লেখা শেষ করার তিন দিনের মধ্যেই মৃত্যু হয় বি আর আম্বেদকরের। ৬ ডিসেম্বর রাত্রে তার দিল্লির বাড়িতে ঘুমের মধ্যেই পরলোক গমন করেন তিনি। ৭ ডিসেম্বর তার মৃতদেহ বোম্বাইতে নিয়ে আসা হয় ।লাখে লাখে মানুষ তার মৃতদেহ ঘিরে হাঁটতে থাকেন শেষকৃত্যের উদ্দেশ্যে। আম্বেদকর যেহেতু বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত ছিলেন তাই তার শেষকৃত্য বৌদ্ধ ধর্ম মতেই পালন করা হয়। তবে সেদিন ঘটে এক আশ্চর্য বিষয়। আম্বেদকরের এই অন্তিম দিনে ইতিহাসে প্রথমবার তাকে সাক্ষী করে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ সেদিন বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন ।
আম্বেদকরের পরলোক গমনের বেশ কয়েক বছর পর তাকে ভারতের শ্রেষ্ঠ সম্মান ভারতরত্নে সম্মানিত করা হয়। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি তাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্কলার রূপে আখ্যায়িত করে। জীবনে চলার পথে ন্যায় বিচার পেতে আমাদের একমাত্র আশ্রয় সংবিধান । ডক্টর ভিমরাও রামজি আম্বেদকর সেই সংবিধানের মধ্যে দিয়েই সদা আমাদের কাছে জীবিত।