Friday, April 26, 2024

হুল দিবস; বিশ্বাসঘাতকদের জন্য শহিদ হতে হয়েছিল সিধু-কানুকে, জেনে নিন সেই আন্দোলনের ইতিহাস

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের সশস্ত্র আন্দোলন ইতিহাসে ‘হুল দিবস’ নামে পরিচিত। ‘হুল’ কথার অর্থ বিদ্রোহ। এই যুদ্ধে প্রায় ২০ হাজার আদিবাসী জীবন দিয়েছিলেন।

স্বাধীনতার প্রথম লড়াই: যদিও স্বাধীনতার প্রথম লড়াই ১৮৫৭ সালে হয়েছিল বলে ধরা হয়, তবে ঝাড়খণ্ডের সাঁওতালরা ১৮৫৫ সালেই বিদ্রোহের পতাকা উত্থাপন করেছিলে। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন সিধু ও কানুর নেতৃত্বে ঝাড়খণ্ডের (Jharkhand) সাহেবগঞ্জ (Sahibganj) জেলার ভগনাডিহি (Bhognadih) গ্রাম থেকে এই বিদ্রোহ শুরু হয়। ভগনাডিহি থেকে কলকাতার অভিমুখে পদযাত্রা করেছিল প্রায় ৩০ হাজার সাঁওতাল কৃষক। ভারতের ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম গণপদযাত্রা।

হুল দিবস; ভারতীয় ইতিহাসের প্রথম গণপদযাত্রা
হুল দিবস; ভারতীয় ইতিহাসের প্রথম গণপদযাত্রা

বিদ্রোহের কারণ:

বর্তমান সাঁওতাল পরগনার এলাকা তখন বঙ্গীয় প্রেসিডেন্সির অধীনে ছিল। পাহাড় ও জঙ্গল দ্বারা বেষ্টিত অঞ্চল। এই এলাকায় বসবাসকারী পাহাড়িয়া, সাঁওতাল ও অন্যান্য বাসিন্দারা কৃষিকাজ করে জীবনযাপন করতেন। তাঁরা জমির জন্য কাউকে রাজস্ব দিতেন না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে জমিদারদের একটি বাহিনী তৈরি করেছিল। যারা পাহাড়িয়া, সাঁওতাল ও অন্যান্য বাসিন্দাদের কাছ থেকে জোর করে খাজনা আদায় করা শুরু করে। খাজনা দেওয়ার জন্য মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হতো তাদের ও মহাজনদের অত্যাচারের মুখোমুখিও হতে হতো। ফলে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ দৃঢ় হতে শুরু করেছিল। চারভাই সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব জনগণের অসন্তোষকে একটি আন্দোলনে রূপান্তরিত করেছিলেন।

বিদ্রোহের শুরুর কথা:

স্থানীয় জমিদার, মহাজন ও ইংরেজ কর্মচারীদের অন্যায় অত্যাচারের শিকার হয়ে ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন ৪০০ টি গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার সাঁওতাল ভগনাডিহি গ্রামে পৌঁছায় ও তাঁরা ঐক্যবদ্ধভাবে ইংরেজদের শাসন-শোষণ, দিকু তথা সুদখোর মহাজন ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। তাদের এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন চার ভাই- সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব। তাঁরা আর রাজস্ব দেবেন না বলে ঘোষণা করেন। এরপর ইংরেজরা সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরবকে গ্রেপ্তার করার আদেশ দেয়। চারভাইকে গ্রেপ্তারের জন্য যে আধিকারিককে পাঠানো হয়েছিল, সাঁওতালরা তাঁর গলা কেটে হত্যা করেছিল। এই ঘটনা সরকারি আধিকারিকদের মধ্যে এই বিদ্রোহ সম্পর্কে ভয়ের সঞ্চার হয়।

বিদ্রোহ দমন করতে ইংরেজরা এই অঞ্চলে সেনা পাঠিয়ে আদিবাসীদের গ্রেপ্তার করেছিল ও বিদ্রোহীদের উপর গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছিল। বিদ্রোহকারীদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জারি করা হয়েছিল সামরিক আইন। ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহকারীদের গ্রেপ্তারের জন্য পুরষ্কার ঘোষণা করেছিল। প্রধান নেতাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য দশ হাজার টাকা, সহকারী নেতাদের প্রত্যেকের জন্য পাঁচ হাজার টাকা করে ও বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় নেতাদের জন্য এক হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছিল। বাহরাইচে (Bahraich) ইংরেজ ও বিদ্রোহকারীদের মধ্যে হওয়া যুদ্ধে চাঁদ ও ভৈরব শহিদ হন। বিখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক উইলিয়াম উইলসন হান্টার (William Wilson Hunter) তাঁর ‘অ্যানালস অফ রুরাল বেঙ্গল’ (Annals of Rural Bengal) বইয়ে লিখেছেন, “সান্থালরা আত্মসমর্পণের বিষয়ে অবগত ছিল না, যার কারণে ডুগডুগি বাজতে থাকে ও লোকেরা লড়াই চালিয়ে যায়।” যতদিন পর্যন্ত একক বিদ্রোহকারী বেঁচে ছিলেন ততদিন লড়াই চলেছে। এই যুদ্ধে প্রায় ২০ হাজার আদিবাসী নিজের জীবন দিয়েছিলেন।

হুল দিবস; এই যুদ্ধে প্রায় ২০ হাজার আদিবাসী নিজের জীবন দিয়েছিলেন
হুল দিবস; এই যুদ্ধে প্রায় ২০ হাজার আদিবাসী নিজের জীবন দিয়েছিলেন

এই ইতিহাসখ্যাত আন্দোলনে সাঁওতাল নারীরাও অত্যন্ত স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অধিকার আদায়ের এই আন্দোলনে সাঁওতাল নারীরা মৃত্যুর ভয়ে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকেননি, তাঁরাও হাতে অস্ত্র তুলে পুরুষদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। সিধু ও কানুর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের অর্থের লোভ দেখিয়ে তাদের সাহায্যে সিধু ও কানু দুই ভাইকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং পরে হত্যা করা হয়েছিল তাদের। চার ভাইয়ের মৃত্যুর পর বিদ্রোহ  স্তিমিত হয়ে পড়ে। সিধু, কানু, চাঁদ এবং ভৈরব- চার ভাই তাদের বীরত্বের কারণে চিরকালের জন্য ভারতীয় ইতিহাসে নিজেদের স্থান করে নিয়েছেন।

সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাসের লিপিকার ও সাঁওতালদের গুরু ছিলেন ‘কলেয়ান গুরু’। তিনি তাঁর “হড়কোড়েন মারে হাপড়ামকো রেয়াঃ কথা” শীর্ষক একটি রচনায় সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাস লিখে গেছেন। এই ইতিবৃত্তে সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধু ও কানুর সংগ্রাম-ধ্বনি, তথা “রাজা-মহারাজাদের খতম করো”, “দিকুদের (বাঙালি মহাজনদের) গঙ্গা পার করে দাও” ও “আমাদের নিজেদের হাতে শাসন চাই” প্রভৃতি লিপিবদ্ধ করা আছে।

Rintu Brahma
Rintu Brahmahttp://www.bonglifeandmore.com
With over six years of dedicated journalism experience, I've transitioned into the role of Bengali Content Specialist at Inshort medialabs private limited after serving as a reporter at Sangbad Pratidin. Armed with a Master's degree in Mass Communication from The University of Burdwan, I bring a deep understanding of media dynamics to my work. Recently, I've embarked on a new journey with Bonglifeandmore.com, where I aim to leverage my expertise to contribute meaningfully to the platform. My commitment to excellence and continuous learning drives me to excel in every endeavor.

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Stay Connected

3,541FansLike
3,210FollowersFollow
2,141FollowersFollow
2,034SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles